বিএনপির পেটে জামায়াত
সিলেটের কন্ঠ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ জানুয়ারি ২০১৬, ১:১২ অপরাহ্ণবিএনপিকে আসলে ধীরে ধীরে জামায়াত গ্রাস করে ফেলেছে। বিএনপিতে এক সময় জামায়াতবিরোধী একটি শক্তিশালী লবি ছিল। বিএনপি নেতাদের মধ্যে যাদের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল তারা জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দহরম-মহরম ভালোভাবে দেখেননি বা মেনে নেননি। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠন এবং পরে সরকার গঠনের পর পরিস্থিতি বদলে যায়।
জামায়াতবিরোধিতার কারণে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য কর্নেল (অব.) অলি আহমদকে কোণঠাসা করে রাখায় (জোট শাসনের শেষ পর্যায়ে অলি আহমদ বিএনপি ছেড়ে নতুন দল গঠন করেছিলেন। এখন আবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে) অন্যরা এই সতর্ক সংকেত পেয়ে যান যে, বিএনপিতে থাকতে হলে জামায়াতবিরোধিতা চলবে না। জামায়াতকে বিএনপির স্বাভাবিক মিত্র হিসেবে গ্রহণ করতে না পারলে বিএনপির রাজনীতি থেকেই ছিটকে পড়তে হবে। ফলে বিএনপির কোনো নেতা আর জামায়াতের বিরুদ্ধে আকারে-ইঙ্গিতেও কিছু বলেন না। আজকাল বরং এ প্রশ্নও কেউ কেউ করছেন যে, বিএনপির ঘাড়ে জামায়াত সওয়ার হয়েছে, নাকি বিএনপিও জামায়াতের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে?
এ কথা ঠিক, বিএনপি যে দেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়েছে সেটার পেছনে জামায়াতের খুব একটা অবদান নেই। বিএনপির সঙ্গে হাত মেলানোর ফলেই জামায়াত ক্রমশই একটি দৃশ্যমান রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। বিএনপির মদদ বা পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতের পক্ষে মাথা তুলে দাঁড়ানো কখনোই সম্ভব হতো না।
পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতার সর্বময় কর্তৃত্ব গ্রহণ করে জামায়াত নেতা গোলাম আযমকে দেশে ফেরার অনুমতি দেন। সামরিক ফরমান বলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর স্বাধীনতার পর যে সাংবিধানিক বিধিনিষেধ ছিল, সেটাও তুলে নেওয়া হয়। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ বিরোধী ভূমিকা পালন করায়, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর স্বভাবতই জামায়াত বাংলাদেশের রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। জামায়াত নেতাদের কেউ কেউ বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন, অনেকে দেশের ভিতরেই আত্মগোপন করেছিলেন। মসজিদ-মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে তখন তাদের হয়তো কিছু গোপন তত্পরতা ছিল, প্রকাশ্যে আসার সুযোগ তারা পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের আগে পায়নি। সে হিসেবে বলা যায়, জিয়াউর রহমান জামায়াতকে পুনর্জন্ম দিয়েছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও জিয়া তার তথাকথিত সমন্বয়ের রাজনীতির নামে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করে দেশের যে ক্ষতি করেছেন, তার কোনো মার্জনা নেই। বিএনপির বদান্যতায় জামায়াত বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছে এবং বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতাতেই জামায়াতের পক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে— যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তারা সক্রিয় বিরোধিতা করেছিল— ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। বিএনপির প্রতি সে জন্যই জামায়াতের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
২০০৫ সালে দেশব্যাপী জঙ্গি তত্পরতার পর কেউ কেউ অনুমান করেছিলেন, দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনা করে বিএনপি পরবর্তী নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে জোট ভেঙেও দিতে পারে। যারা এমন ধারণা পোষণ করেছিলেন, তারা জামায়াতের রাজনৈতিক ফন্দি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানেন না, সেটা পরবর্তী সময়ে প্রমাণিত হয়েছে। জামায়াত চেয়েছে, যে কোনো মূল্যে বিএনপির সঙ্গে ঐক্য বজায় রেখে আরেকবার ক্ষমতার অংশীদার হতে। বিএনপির সঙ্গে জোটে থেকে মন্ত্রিত্বের ভাগ না পেলে জামায়াতের মূল পরিকল্পনা— অর্থাৎ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল— বাস্তবায়ন করা সহজ হবে না।
মাত্র এক টার্ম ক্ষমতায় থেকেই এতটা শক্তি সঞ্চয় করা সম্ভব ছিল না, যাতে তারা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখতে পারে। তবে তারা যে সরকারের অংশীদার হয়ে তলা গোছানোর কাজটি অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবেই করেছে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন বিএনপি নেতারা বুঝতে পারেননি যে, জামায়াত তাদের জন্য কত বড় ক্ষতির কারণ হয়েছে, তারা সুই হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোনোর চেষ্টা করেছে। জামায়াত নেতারা এটা ভালোই বোঝেন যে, বিএনপি-নির্ভরতা তাদের শক্তিবৃদ্ধির জন্য কত বড় সহায়ক।
জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের টানাপড়েন নিয়ে কোনো কোনো পত্রিকায় মাঝে মধ্যেই কিছু খবর বের হলেও বাস্তবে এই দুই দলের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে বলে অনেক পর্যবেক্ষকই মনে করেন না। বিএনপিকে যারা জামায়াতমুক্ত দেখতে চান, তারা এক ধরনের স্বপ্নালোকে বাস করেন। যারা বিএনপির ভিতরের খবর রাখেন, তারা জানেন যে, বিএনপির নীতিনির্ধারকরা সব সময় মনে করেন কৌশলগত কারণে কখনো কখনো সম্পর্কের ক্ষেত্রে শীতলতা বা কিছুটা দূরত্ব দেখালেও জামায়াতকে চটানোর ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। বিএনপির ঘাড়ে চেপে জামায়াতের যেমন লাভ হয়েছে তেমনি জামায়াতের ঘাড়ে চাপার জন্যই তো বিএনপিরও ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসা সম্ভব হয়েছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াতের ১০ শতাংশ ভোট যোগ না হলে নির্বাচনের ফলাফল কি দাঁড়াত সেটা কি আর বিএনপির হিসাবে নেই? বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি সম্পূর্ণ এক নয় বলে যারা মনে করেন, তারাও এক ধরনের বিভ্রান্তির মধ্যেই আছেন। জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠনের পরে বিএনপির অভ্যন্তরীণ পোলারাইজেশনের ফলে দলের নীতিগত অবস্থান যে অনেকটাই বদলে গেছে, এটা কেউ কেউ বুঝতে চান না। ২০০১-০৬ সময়ে জোট সরকারের আমলে কেউ কেউ এমনও বলেছিলেন যে, বিএনপি হলো জোট সরকারের হার্ডওয়্যার আর সফটওয়্যার হলো জামায়াত। অর্থাৎ জামায়াতই যেন ক্রমশ বিএনপির মূল চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়। জামায়াতকে উপেক্ষা করার উপায় নেই বিএনপির। সফটওয়্যার ছাড়া হার্ডওয়্যার তো একেবারেই মূল্যহীন।
জামায়াতের ওয়াজী নেতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী একসময় প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, ‘বিএনপি ও জামায়াত একই মায়ের পেটের দুই ভাই’। এ দুই ভাইয়ের মধ্যে কে অগ্রজ আর কে অনুজ সেটা অবশ্য সাঈদী বলেননি। তবে সাঈদী এটা বলেছিলেন যে, বাস্তবে এই দুই দলের মধ্যে নীতিগত কোনো পার্থক্য নেই। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। অপর দিকে জামায়াতে ইসলামীও বাংলাদেশে ইসলামী শাসন কায়েম করতে চায়। আদর্শের বিচারে তাই দুই দলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তাই বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই।
বিএনপির কোনো নেতা সাঈদীর এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছিলেন বলে শোনা যায়নি। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র বানাতে চেয়েছিলেন, বিএনপি নেতারা কি এই বক্তব্য সত্য বলে মেনে নিয়েছেন? রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা অবশ্য তখন সাঈদীর বক্তব্যে মোটেও বিস্মিত হননি। জিয়াউর রহমান হয়তো প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে এটা বলেননি যে, তিনি বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র বানাতে চান। কিন্তু বাস্তবে সংবিধান সংশোধন করে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাদ দেওয়া, বিসমিল্লাহ সংযোজন, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারসহ যা যা করেছেন তার সবই রাষ্ট্রকে সাম্প্রদায়িক চরিত্র দেওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। এখন প্রশ্ন হলো, আদর্শের বিচারে দুই দলের মধ্যে যদি সত্যি কোনো পার্থক্য না থাকে, তাহলে দুই দলের আলাদা অস্তিত্বের প্রয়োজন কি? এখন পরিস্থিতির কারণে জামায়াত যদি প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ হারায় তাহলে কি তারা বিএনপির মধ্যেই বিলীন হয়ে যাবে না?
মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের শীর্ষ নেতারা অনেকেই দণ্ডিত হয়েছেন, কয়েকজনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। প্রথমদিকে জামায়াত মনে করছিল, দেশের মধ্যে সহিংসতার মাধ্যমে শক্তি প্রদর্শন করে, বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে এবং সরকারের ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে হয়তো তারা তাদের নেতাদের বাঁচাতে পারবে। কিন্তু এখন তাদের কাছে এটা স্পষ্ট যে, শেখ হাসিনার সরকারকে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে কোনোভাবেই নমনীয় করা যাবে না। একাত্তরের অপরাধ থেকে জামায়াত নেতাদের রেহাই মিলবে না। এমনকি আজ হোক আর কাল হোক, যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবে জামায়াত আইনি প্রক্রিয়াতেই হয়তো নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। সরকারের কঠোরতার কারণে জামায়াতের শক্তি এখন অনেকটাই দুর্বল। হরতাল ডেকেও তারা এখন আর মাঠে নামার ক্ষমতা রাখে না। জামায়াত তাই এখন কৌশল বদল করছে। তারা এখন আবার হয়তো আত্মগোপনে যাবে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মুহূর্তে জামায়াত নেতা মুজাহিদী যেমন নিজ সমর্থকদের ভবিষ্যতে উপযুক্ত সময়ে ফিরে আসার লক্ষ্যে হিজরতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন, তেমনি এখনো হয়তো তারা শক্তিক্ষয় না করে শক্তি সঞ্চয়ের পথেই হাঁটবে। গোপন তত্পরতা চালানোর পাশাপাশি অন্য কোনো দলে ঢুকে পড়ার কৌশল নেবে। সেক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে তাদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকবে বিএনপি। যদিও কোথাও কোথাও জামায়াতিরা আওয়ামী লীগের ছাতার নিচেও আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছে এবং আরও করবে। কিন্তু আওয়ামী লীগের ছাতা যে জামায়াতের জন্য বেশি নিরাপদ নয়, সেটাও তারা ভালোই বোঝে।
জামায়াত এখন সব দিক দিয়েই বেকায়দায় আছে। বিএনপিকেও হয়তো কোনো কোনো ক্ষেত্রে এড়িয়ে চলার কৌশল নিচ্ছে। পৌর নির্বাচনে তার কিছু লক্ষণ দেখা গেছে। বিএনপির সামনে এখন একটি বড় সুযোগ ছিল জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদের প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে নিজেদের ইমেজ উজ্জ্বল করার। বিএনপির ওপর দেশ-বিদেশের নানা মহলের চাপও ছিল জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার। এই কাজটি করে নিজেদের অনুকূলে পয়েন্ট সংগ্রহের সুযোগ বিএনপি হাতছাড়া করছে এ জন্যই যে, তারা মনে করছে, জামায়াতকে কোনোভাবেই ‘ব্যাজার’ করা ঠিক হবে না। সম্ভবত জামায়াতের প্রতি অতি অনুরাগের কারণেই বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন কি না সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করে বক্তৃতা দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, জামায়াতের রাজনীতি ধারণ করে, কিংবা জামায়াতকে পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে বিএনপির পথ চলা কি খুব সুখের হবে? বিএনপিকে আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরে আসতে হলে যেসব শক্তিকেন্দ্রের সমর্থন প্রয়োজন, জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা থাকলে সেসব শক্তিকেন্দ্রের আনুকূল্য পাওয়া কি আদৌ সম্ভব? জামায়াতকে ‘না’-বলার এই সুযোগ হাতছাড়া করলে বিএনপিকে আবারও হয়তো পস্তাতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
. . . . . . . . .