জকিগঞ্জের এশনু পেলেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি
সিলেটের কন্ঠ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ অক্টোবর ২০১৫, ৪:৪৭ অপরাহ্ণবিশেষ প্রতিনিধি::
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয় দেশের ৪১ বীর নারীকে বীরঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা দিয়ে রাস্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়েছে। গতকাল সোমবার একাত্তরের পাকিস্তানী বাহিনী ও রাজাকারদের হাতে নির্যাতিত ৪১ বীরাঙ্গনার নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তভূক্ত করে গেজেট প্রকাশ করা হয়। তারা চলতি বছরের জুলাই থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদেও মত সুযোগ সুবিধা পাবেন। এই ৪১ বীর নারীর মধ্যে সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার বারহাল ইউনিয়নের এসনু বেগমের নামও রয়েছে।
স্বাধীনতার পর থেকেই জীর্ণশীর্ণ ঘর, দরজা জানালা ভাঙ্গা, ভাঙ্গাচোরা বাঁশের বেড়া, ঘরের ভিতর একটি কাঠের চৌকিতে রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়েই অনাহার অর্ধাহারে জীবন সংগ্রাম করে আসছেন এই নারী। আজ থেকে ১৮ বছর আগে বাবা আর ১২ বছর পূর্বে মা মারা যান এসনুর। ছেলে মেয়ে কেউ নেই। আত্মীয় বলতে আছেন দুই বোন। এখনো লজ্জায় মুখ লুকিয়ে রাখেন। বৃদ্ধ বয়সেও শীতলপাটি ও বাঁশ দিয়ে ডাম, চাটাই ইত্যাদি তৈরী করে দিনে দু’মুটো ভাত যোগান। অভাব পিছু না ছাড়লেও কোনদিন কারো কাছে হাত পাতেননি তিনি।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মা-বাবার সংসারে তিনি ছিলেন একা। দুই বোন লেবু বিবি ও লেচু বিবির বিয়ে হয়ে যায়। প্রাইমারীর গন্ডি পাড়ি দিতে পারেননি। যুদ্ধ শুরুর আগেই লেখাপড়া ছেড়ে দেন এসনু। যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ১৩/১৪ বছরের কিশোরী। শুধু তার গ্রাম নয় আশপাশ গ্রামে তার মতো সুন্দরী কমই ছিল। পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর স্থানীয় এক মনোরঞ্জন যোগাতার লুলুপ দৃষ্টি পড়ে তার উপর। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে একদিন গভীর রাতে স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় তার বাড়ীতে হানাদেয় পাকবাহিনী। চোখমুখ বেঁধে নিয়ে যায় শাহগলী বাজারস্থ পাকিস্থানী বাহিনীর বন্দিশিবিরে। চলে অমানবিক নির্যাতন। চার দিন ক্যাম্পে আটকিয়ে রেখে পৈশাচিক নির্যাতন চালায় তারা। একাত্তরের বীরাঙ্গনা এসনু বেগমকে সেই ভয়াল স্মৃতি এখনো তাড়া করে। ঐ ঘটনা মনে হলে তাঁর বুক এখনো ধড়ফড় করে।
সিলেটের সীমান্ত এলাকা জকিগঞ্জ উপজেলার বারহাল ইউনিয়নের মনতইল গ্রামের ময়গুন বেগম ও রিয়াছদ আলীর মেয়ে এসনু বেগমের বয়স এখন ৫৯। দেশ স্বাধীন হওয়ায় ৪৪ বছর পেরিয়ে গেলেও এতদিন তার পাশে কেউ দাঁড়ায়নি। কোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আজো আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে সম্মান জানায়নি। তিনি জানান, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শফিকুর রহমানসহ কয়েকজন এসে তার ছবি, নাম ঠিকানা ও ঘটনার বর্ণনা নিলেও এরপর আর কেউ তার খবর রাখেনি। এসনু বলেন-শইল্লে নানা ব্যরাম। ঔষধ বাকর নাই। ব্যথা অইলে রসুন তেল ঘষি শইল্লে।
একাত্তরের সেই পৈশাচিক কাহিনীর কথা বলতে গিয়ে বাক রূদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি। বলেন, “সংগ্রামের বরছ(বছর) আমি হুরু আছলাম। দুই বনির(বোনের) বিয়া অইগেলে আমি অইলাম একলা। একদিন মাজরাইতে আকতা(হঠাৎ) কয়জন রাজাকার মিলিটারী লইয়া আমরার বাড়ীঘর গেরাও কইরা মা-বাপর সামনে আমার চউখ বাইন্দা ফালায়। পরে জোরে ধইরা আমারে তাদের ক্যামেপ লইয়া যায়।” শোকগাঁথা বলতে গিয়ে অশ্র“ সংবরণ করতে পারেননি এসনু। পাকিস্থানী ক্যাম্পে নিয়ে অফিসাররা তাকে পালাক্রমে পৈশাচিক নির্যাতন করে। এভাবেই চলে চার দিন। তাকে ছেড়ে দেয়া হলেও সেই অভিশাপের ছাপ এখনো তার মন ও শরীরজুড়ে।
এসনু বেগম বলেন, বাড়ীতে আওনের বাদে লজ্জায় লোকজনের সামনে বাইর হইতে পারতাম নায়। মুখ সব সময় কাপড় দি ডাইক্কা রাখতাম। মাইনষের কত বাদ বাদ(খারাপ) কথা হুনতে অইছে। কেউ তাকে বিয়ে করতে রাজী হয়নি। নিজে কোনো অপরাধ না করেও হয়েছেন নিগৃহীত, পেয়েছেন বঞ্চনা; কাটাচ্ছেন মানবেতর জীবন।
যুদ্ধের কয়েক বছর পর বাধ্য হয়ে বাবা-মা গ্রামের বিবাহিত বয়োবৃদ্ধ জমির আলীর সাথে বিবাহ দেন এসনুকে। দরিদ্র জমির আলী মাছ ধরে সংসার চালাতেন। পরপর দু’টি ছেলে সন্তান জন্ম নিলেও জন্মের পরপরই মারা যায় তারা। এক পর্যায়ে স্বামী নামের ছাতার ছায়াটাও সরে যায় এসনুর মাথা থেকে । বিয়ের মাত্র কয়েক বছরের মাথায় বার্ধক্যজনিত রোগে বিনা চিকিৎসায় মারা যান জমির আলী। এবার আশ্রয় হয় পিতা-মাতার ছোট্ট ভিটায়। অনাহারে অর্ধাহারে কাটছে তার একার সংসার। জীবন সায়াহ্ণে এসেও এই পৈশাচিকতার বিচার চান তিনি।
এসনুর প্রতিবেশি সাজনা সুলতানা হক চৌধুরী বলেন- রুপ লাবন্যই এসনুর জীবনের জন্য বড় কাল হয়ে দাঁড়ায়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তার জীবনটাকে ওলটপালট করে দেয়। পাক হিং¯্র হায়েনাদের নিষ্ঠুর থাবা এসনুকে স্পর্শ না করলে রুপসী এসনুর জীবনটা অন্য রকম হতে পারতো। সবই নিয়তি। এসনুদের বিশাল ত্যাগের উপর দাঁড়িয়ে আমরা আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক অথচ কেউ তাদের খবর রাখে না।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শফিকুর রহমান বলেন, বীরাঙ্গনা এসনু সম্ভ্রম হারিয়েছেন একাত্তরে। সেই সাথে হারিয়েছেন সামাজিক স্বীকৃতিও। তারপর স্বামী- সন্তান মা -বাবা সবাইকে হারিয়ে তিনি পুরোপুরি নি:স্ব হন। পেয়েছেন অপমান আর অবহেলা। বুক ভরা কষ্ট নিয়েই বেঁচে আছেন তিনি। মাথা গোজার ভিটে ছাড়া তার নিজের বলতে কিছুই নেই। তাঁর ঘর বলতে বুঝায় একটি ঝোপড়িকে। সেখানে খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন এই বীরাঙ্গনা জননী। দুঃখ কষ্টের মাঝেও কারো কাছে মাথা নত করেননি এসনু। শেষ বয়সে এসে অতিকষ্টে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তবে কেউ কেউ তাঁকে স্বেচ্ছায় যাকাত, ফিৎরা বা কোরবানির চামড়ার পয়সা দেন মাঝে-মধ্যে।
পাক হানাদার এবং তাদের এদেশীয় দোষর রাজাকারদের বর্বরতার শিকার এসনু বেগমের বোন লেবু বিবি বলেন-আমার কুমারি বইনরে যে রাজাকারের সাহায্যে তুইল্যা নেওয়া অইছিল নির্যাতন কইরা ছাইরা দেওয়ার সময় কইছিল সে তারে বিয়া করব। পরে আর বিয়া করে নাই। লেবু বলেন-তাইন(এসনু) দেশের লাগি কোনতা করছইন ই কতাখান সরকারে কইলে আমরা শান্তি পাইতাম। বইনে অত দিনে একটা কাগজও পাইল না । ৪৪ বরছ বাদে ই বরছ তাইন পাওয়ার মাঝে পাইছইন পাচ হাজার ট্যাকা। এবলা আমরা তাইনর খবর হুইনা খুশি অইছি।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার খলিল উদ্দিন বলেন, স্থানীয় এক প্রভাবশালী রাজাকারের সহযোগীতায় তাকে ধরে নিয়ে পৈশাচিক নির্যাতন করে পাক বাহিনীর সদস্যরা। উপজেলার ইকমাত্র বীরাঙ্গনা নারী মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়ায় তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানান। তিনি এসনুর সম্ব্রমহাণিকারী রাজাকারদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবী করেন।
. . . . . . . . .