ইট-পাথরের নগরে দৃষ্টিনন্দন ছাদ বাগান
মইনুল হাসান আবির:
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ মার্চ ২০২৪, ১০:৫৪ অপরাহ্ণছবি:নগরীর সাগর দিঘিরপাড় এলাকায় দৃষ্টিনন্দন ছাদ বাগান থেকে বৃক্ষপ্রেমী ‘রওশন জলি’
সবুজ মানেই প্রকৃতি। প্রকৃতি মানেই প্রাণ। ইট-পাথর আর শব্দ-দূষণের চাপায় ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ। সবুজে ভরা গ্রাম বাংলায় বেড়ে উঠা নাগরিক সমাজের একটা অংশ সবুজকে ধরে রাখতে চায় আবাসস্থলে। শৌখিন মানুষরা তাদের ঘরবাড়িতে সবুজকে ধরে রাখার জন্য একান্ত নিজস্ব ভাবনা আর প্রচেষ্টায় বাড়ির ছাদে তৈরি করছে ছাদ বাগান। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র যেন পরিবেশ ধ্বংসের এক নগ্ন উল্লাস চলছে। তেমনি শ্যামল সিলেটেও সবুজ বৃক্ষের শোভা হারাচ্ছে নগর। একদিকে যেমন নতুন নতুন বহুতল ভবনের ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করা হচ্ছে। অন্যদিকে কেটে ফেলা হচ্ছে পুরনো বাড়ির চারপাশে থাকা গাছ।
শতবর্ষ আগে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ’দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর’। হয়তবা কবির আকুতিতে সাড়া দিচ্ছেন কেউ কেউ। তাই যান্ত্রিক শহরে অনেকে জাগিয়ে তুলছেন সবুজ প্রাণের ছোঁয়া। এমনই একজন রওশন আরা ‘জলি’।
তিনি নগরীর শ্যামল সিলেটে ব্লু-বার্ড স্কুল এন্ড কলেজের ইংরেজি প্রভাষক। যান্ত্রিক নগর জীবন মাথায় নিয়ে কলেজ শিক্ষিকা পেশাগত কাজের পাশাপাশি প্রকৃতি ও গাছের প্রতি অন্যরকম এক ভালোলাগা ও ভালোবাসা থেকে নগরীর সাগর দিঘিরপাড় এলাকায় ভাড়া বাসস্থানে গড়ে তুলেছেন দৃষ্টিনন্দন একটি সবুজ উদ্যান। বাগান তো নয়, যেন এক টুকরো ভালোবাসার বাগান। যেখানে দেখা মিলে অন্যরকম স্বর্গীয় পরিবেশ। দৃষ্টিনন্দন এইবাসায় যেদিকে চোখ যায় শুধু গাছ আর গাছ। ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে বাসার চারপাশ। বেলকনিতেও ঝুলছে ঝুলন লতা। ফুটেছে নানান রঙের ফুল। বাগানের সবুজের সমারোহ দেখে যে কারোই চোখ জুড়িয়ে যাবে। তার বাসাটা যেন প্রকৃতির নির্দশন। ছাদে এসে বাগানটি দেখে যে কারোর’ই মনে হবে এ যেন ছাদ নয়, যেন এক টুকরো নির্মল উদ্যান।
ছবি: কলেজ শিক্ষিকা ‘রওশন আরা জলি’র নতুন নতুন ফুল ।
ছাদ বাগান শুরুর গল্প সম্পর্কে শিক্ষিকা রওশন জলি জানান, গাছ-গাছালির প্রতি টানটা আমার ছোটবেলা থেকেই। নিজের গ্রামের বাড়িতে যখন ছিলাম বাড়ির উঠানে সব ধরনের গাছ লাগাইতাম গাছ কিনতে বাবাও সাহায্য করতো। এরপর যখন নিজের সংসার হলো শুরু হলো বারান্দা সাজানো। ২০০৮ সালে যান্ত্রিক নগরে ছাদ বাগান করা শুরু করি। শুরুর দিকে অনলাইনের মাধ্যমে থাইল্যান্ডের চারা (ঢাকা, রাজশাহী) থেকে ক্যাক্টাস গাছ ক্রয় করতাম প্রতি চারা ৮০০-১০০০ টাকায় সাথে পরিবহন ব্যয় আরো তত টাকা খরচ হতো। প্রত্যেকটা গাছ সংগ্রহের পেছনে রয়েছে অনেক ত্যাগ, কষ্ট আর শ্রম। যখন যেখানেই যাই সেখানেই আমার পছন্দের গাছটি খোঁজ করি। বর্তমানে আমার বাগানে ১০ হাজার টাকা দামের গাছও রয়েছে।
তিনি বলেন, এখন আমার পুরো বাসায় ১,৫০০ টিরও বেশি গাছ আছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে নিয়ে আসা কিছু গাছের সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে নিজের গাছের চারাও। আমি গাছ সাজাতেও অনেক ভালোবাসি। কোন গাছকে কোন টবে দিলে মানাবে সেই অনুযায়ী আমি টব সিলেক্ট করি। আমার বেশ সুন্দর টব ও ছোট-বড় অনেক রকম পাথরের কালেকশন আছে। এগুলো আমি অনেকদিন ধরে বিভিন্ন জায়গা থেকে কালেক্ট করেছি। তবে আমরা যারা ভাড়া বাড়িতে থাকি ছাদ বাগান করতে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় প্রথমেই অনেকগুলো সরঞ্জাম কিনতে হয়, ঘন ঘন পরিছন্নতা করতে হয়, ভালো মাটি ব্যবহার করতে হয় যাতে করে পানিতে মিশে না যায়। যার ফলে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।
ছবি:বৃক্ষপ্রেমী ‘রওশন জলি’র ছাদ বাগান থেকে অর্কিড, ক্যাক্টাস সহ বিভিন্ন প্রজাতির ফুল।
পুরো ছাদে দেড় হাজার গাছ নিয়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন প্রজাতির গাছের মধ্যে ক্যাক্টাস, গোল্ডেন ব্যরেল, কডিসিফর্মিং ফ্লাওয়ারিং ও ননফ্লাওয়ারিং অনেক ভেরাইটি, বিভিন্ন জাতের অর্কিড, অর্কিডের মধ্যে ডেনড্রোবিয়াম, ক্যাটালিয়া, এপি ডেনড্রাম, ডেন নভেলি, কাটাসেটাম, সিলোজিনি, বিভিন্ন জাতের সাকুলেন্ট, বাগান বিলাস, এডেনিয়াম, বিভিন্ন প্রজাতির হয়া, কাটামুকুট, ব্রোমেলিয়াড, বেগুনিয়া, কাঠগোলাপ, বিভিন্ন প্রজাতির এয়ার প্লান্ট, বিভিন্ন ধরনের পাথোস, ইনডোর প্লান্ট, বিভিন্ন ধরনের সয়েল অর্কিড, প্রায় দুশ প্রজাতি, লিলি এবং অন্যান্য আরও অনেক গাছ আছে আমার ছাদে। প্রতিদিন একবার হলেও আমি গাছগুলোর কাছে বসি। শত ব্যস্ততা থাকলেও গাছগুলোকে একটু সময় দেই পরিচর্যা করি।
তিনি আরও জানান, শখ পূরণের পাশাপাশি করোনার সময় ঘরে বসে ক্যাক্টাসের চারা অনলাইনের মাধ্যমে অর্ডার নিয়ে বিক্রয় করে বেশ কিছু টাকাও আয় করেছেন তিনি। শুধু বাসায় নন ব্লু-বার্ড স্কুল এন্ড কলেজেও একইভাবে গাছ লাগানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
ছবি: নগরীর সাগর দিঘিরপাড় এলাকায় দৃষ্টিনন্দন ছাদ বাগান থেকে বৃক্ষপ্রেমী ‘রওশন জলি’
বৃক্ষপ্রেমী শিক্ষিকা রওশন জলি বলেন, আমার বাসায় কিন্তু একজন পদার্থ বিজ্ঞানের প্রভাষক বসবাস করেন। তিনি হলেন, আমার স্বামী মোহাম্মদ খায়রুল আমিন। তিনিও প্রকৃতিকে ভালোবাসে আমার বাগানে প্রতিদিন নতুন নতুন ফুলের ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে শেয়ার করেন এবং আমি মনে করি বাগান করার ক্ষেত্রে পরিবারের সাপোর্ট ও সেক্রিফাইস সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। আমার স্বামী ও আমার সন্তানরা আমাকে অনেক সাপোর্ট করে, অনেক সেক্রিফাইস করে।
সকলের উদ্দেশে তিনি বলেন, জীবন-জীবিকার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে শহরে থাকতে হয় অনেককেই। এই উন্নত জীবনযাপনের মাঝেও আমাদের মন কেঁদে ওঠে গ্রামের এক টুকরো সবুজের জন্য। কিন্তু শহরে যে সারি সারি উঁচু দালানবাড়ি, সবুজের দেখা মেলে না সহজে। তাই বাসার ব্যালকনিতে কিংবা ছাদে করতে পারেন বাগান। গ্রামের স্নিগ্ধতা না থাকলেও টুকিটাকি গাছেও শান্তি পাবেন। ‘আসুন আমরা বেশি বেশি গাছ লাগাই, বাগান করি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সবুজের সমারোহে গড়ে তুলি’
সিলেট/আবির