ছোটগল্প: বন্ধনহীন সম্পর্ক
সুলেখা আক্তার শান্তা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১:৪৬ অপরাহ্ণনাদিয়া আর ঋতু অন্তরের বান্ধবী। গলায় গলায় ভাব। একজন আরেকজনকে ছাড়া চলতে পারে না। দুজন একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়ে। ভালোই চলছিল। হঠাৎ তাদের বন্ধুত্বে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ঋতুর ভাই জাবেদ। বোনকে বারণ করে দেয় তুই কখনোই নাদিয়ার সঙ্গে মিশবি না। কে শোনে কার বারণ দুইজনে ঠিকই সম্পর্ক রক্ষা করে চলে। ভাইকে দেখলে আড়াল হয়ে যায়। এত বারণ এত নিষেধ যার সেই জাবেদ ছোট বয়সেই নাদিয়ার প্রেমে পড়ে। জাবেদ প্রেম নিবেদন করলে নাদিয়া গ্রহণ করে প্রেমের প্রস্তাব। সেই থেকে প্রেম। বয়সে ছোট হলেও কিশোর প্রেমের দুর্নিবার আকর্ষণে বিভোর দুজন। একে অপরকে ছাড়ে থাকা দুষ্কর। প্রথমে তারা ছোট বলে এড়িয়ে গেলেও ধীরে ধীরে ব্যাপারটা এলাকার সবার নজরে আসে।
নাদিয়ার মা লিলি বেগম মেয়ের প্রেমের ব্যাপারে জানতে পেরে মেয়েকে ঘর থেকে বের হতে দেয় না। নাদিয়া কিছুতেই ঘরে থাকতে চায় না সে স্কুলের কথা বলে বের হয়। স্কুল বাদ দিয়ে জাবেদের সঙ্গে দেখা করতে যায়। যেভাবে হোক প্রতিদিন তাদের দেখা করতেই হবে। লিলি বেগম মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। তোর পড়ালেখা করতে হবে ঘরে বসে, স্কুলে যেতে হবে না। ছেলেটা তো একটা আস্ত বাঁদর। এমন বখে যাওয়া ছেলের সঙ্গে ঘোরাফেরা করা চলবে না। যে ছেলে পড়ালেখা করে না, কোন কাজকর্ম নাই। সারাক্ষণ মাস্তানি করে বেড়ায়। সেই ছেলের সঙ্গে কিসের চলাফেরা। নাদিয়া বুঝাতে চায়, মা জাবেদ অনেক ভালো ছেলে। মেয়ের মুখে এ কথা শুনে লিলি বেগম আরো ক্ষিপ্ত হয়। ভালো-মন্দের সার্টিফিকেট তোর কাছ থেকে নিতে হবে না। যে ছেলেকে মহল্লার কেউ দেখতে পারে না যার নামে থানায় মামলা সেই ছেলের কথা ভালো মন্দের সাফাই শুনতে হবে তোর মুখে। মা আমার চলাফেরার স্বাধীনতা থাকা উচিত। এভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলে আমি পড়ালেখা করবো না। তুমি আমাকে বন্দী করে রাখতে চাও রাখো। নাদিয়ার বান্ধবী ঋতু আসে ভাইয়ের খবরা খবর নিয়ে। জাবেদের লেখা চিঠি দেয় নাদিয়াকে। লিলি বেগম টের পেয়ে যায় গোপন যোগাযোগের বিষয়। সে ঋতুর আসা বন্ধ করে দেয়। নাদিয়া অস্থির হয়ে যায় কী করবে বুঝতে পারেনা। সে পালিয়ে বের হবার সিদ্ধান্ত নেয় এবং তাই করে। জাবেদের কাছে গিয়ে বলে, মা আমাকে কিছুতেই বের হতে দেয় না। আমি তোমাকে না দেখে থাকতে পারিনা। জাবেদের ও একই কথা। কিশোর প্রেমের অপরিণত আবেগ। ভাবে কী করে দুজনে একসঙ্গে থাকা যায়। সিদ্ধান্ত নেয়, তারা বিয়ে করবে। বন্ধুবান্ধবের সহায়তায় বিয়েটা করেই ফেলে। তাদের এই কান্ড দু পক্ষের গার্জিয়ারা জানতে পেরে রাগারাগি করে। এতটুকু ছেলে-মেয়ে তারা আবার করছে বিয়ে। যারা নিজের খরচ নিজে চালাতে পারে না তারা আবার সঙ্গীর বোঝা নিয়েছে কাঁধে।
জাবেদ বউ নিয়ে তাদের বাসায় উঠে। মা বাবা বকা দেয় দেক, তারপর তো তারা খাওয়া পড়া দিবে। নাদিয়ার মায়ের বাসা কাছে হলেও সেখানে যাওয়া হয় না। হোসনারা ছেলেকে বলে, জাবেদ তুই এখন একটা কিছু কর বাবা। একটা মানুষের খাইতে পড়তে তো আর কম লাগে না। খরচ খরচার ব্যাপারটা ভাবো। কী করে তার জোগাড় হবে চিন্তা কর। জাবেদ কী করবে, কোন কাজ খুঁজে পায় না। পড়ালেখাও করে নাই। মাস্তানি দলবাজি করতো, ছেড়ে দিয়েছে। এখন মাস্তানিতে যায় না, মাস্তানি করত বলে কেউ এখন কাজও দেয় না। কথায় বলে অভাব যখন দেখা দেয় ভালবাসাও জানলা দিয়ে পলায়। নাদিয়া বলে, বিয়ে করছো এখন বউয়ের খরচ চালাও। জাবেদর এক উত্তর, আমি কাজ করতে চাই কিন্তু কাজ তো পাই না। ভয়ে কেউ কাজ দিতে চায় না। মাস্তান ছিলান এখন তো মাস্তানি করি না। মাস্তানি ছেড়ে দিলাম সেটা কারও চোখে পড়ে না।
নাদিয়ার গর্ভে সন্তান আসে। অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে সে। স্বামী কোন খরচ বহন করতে পারে না তার উপর সন্তান আসছে, কী উপায় হবে। মায়ের কথা মনে পড়ে। মায়ের কাছে গিয়ে বকাঝকা শুনতে হয়। একা একা বিয়ে করেছ কারো কথা শুনোনি। এখন যেভাবে পারো সামলাও জীবন। তখন কত বুঝাইলাম মায়ের কোন নিষেধ শোন নাই। নিজেরা চলতে পারো না আবার সন্তান নিয়ে নিছো। লিলি বেগম ক্ষোভের সঙ্গে বলে। তোমার বাবা তোমাদের জন্ম দিয়ে ফেলে গেছে। চাকরি বাকরি করে তোমাদের খাওয়াইছি পড়াইছি। কি হলো মায়ের দুঃখ বুঝলানা। নিজের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করলা। পরামর্শ তো দূরের কথা এটা মুখের কথা বলিস নাই। যাকে ভালোবেসে বিয়ে করছো এখন তার কাছেই থাকো। তখন মায়ের বুঝ ভালো লাগে নাই। মায়ের কাছে না আইসা যাকে ভালোবেসে বিয়ে করছো তার কাছে গিয়া থাকো। মায়ের কাছে আশ্রয় না পেয়ে নাদিয়া স্বামীর বাসায় চলে যায়।
নাদিয়ার বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হয়। সংকটের উপর সংকট। বাচ্চা বুকের দুধ পায় না। কৌটার দুধ কিনে খাওয়াবে তাতেও পেরেশানির শেষ নাই। নিজে না খেয়ে থাকা যায় কিন্তু ছোট্ট শিশুকে কি না খাইয়ে রাখা যায়! স্বামীর সঙ্গে লাগে দ্বন্দ্ব। বউ বাচ্চার খাওয়ার জোগাড় করতে পারো না বিয়ে করছিলা কেন? আক্কেলে নাই? জাবেদের কথা, বিয়ে কি আমার একার ইচ্ছায় হয়েছে। তোমারও ইচ্ছা ছিল তাই হয়েছে। তখন আবেগ দিয়ে চলায় আজ আমার এই অবস্থা। নাদিয়া দেখে স্বামীর কাজ করার ইচ্ছা নেই। আবার ভয়েও কেউ তাকে কাজের দেয় না। অভাবে নিরুপায় তার কোনো কিছু ভালো লাগে না। সে বাচ্চা নিয়ে চলে যায় মায়ের বাসায়। মা বকা দেও আর যাই করো আমাকে তুমি আশ্রয় দাও। মায়ের মন, সন্তান ভুল করেছে তাই বলে দুঃসময় তো তাকে ফেলে দেওয়া যায় না। তারপর সে এখন একটা শিশু সন্তানের মা।
নাদিয়ার স্বামীর বাসায় যায় না। জাবেদের যখন সন্তান দেখতে ইচ্ছা করে সে এসে দেখে যায়। লিলি বেগেম মেয়ের কথা ভেবে। এইভাবে কি মেয়ের জীবন যাবে। আজ সে বেঁচে আছে তাই মেয়েকে আশ্রয় দিতে পেরেছে। যখন তার কিছু হবে তখন কী হবে মেয়েটার। লিলি বেগেমের বয়স হয়েছে। কাজ করার শক্তি সামর্থ্য কমে আসছে। নানান ধরনের অসুখ বিশুকে অচল হয়ে পড়ে সে। চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। সংসারে হাল ধরে ছেলে রাজিব।
নাদিয়া স্বামীকে ডিভোর্স লেটার পাঠায়। জাবেদ ডিভোর্স লটারে সই করে দেয়। ডিভোর্স হওয়ার পর মেয়েদের কপালের দুর্ভোগ তাকেও ভোগ করতে হয়। যত দোষ মেয়েদের। মায়ের দুশ্চিন্তা ক্রমেই বাড়তে থাকে। একসময় বলে, আবার তুই সংসারী হ। নাদিয়া ভাবে সংসারী হলে তার ছেলের কী উপায় হবে। শুনতে পায় ডিভোর্সের পর জাবেদ বিয়ে করেছে। লিলি বেগম মেয়েকে বুঝায়, জাবেদ বিয়ে করে ফেলছে তুই ছেলে নিয়ে কেন পড়ে থাকবি তুইও বিয়ে কর। ছেলেকে বাবার কাছে দিয়ে তুই বিয়ে করে ফেল। নাদিয়া নিয়তির সঙ্গে যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। মায়ার বাঁধন ছিড়ে মিতুলকে তার বাবার কাছে পাঠিয়ে দেয়। ছেলের জন্য বুকের মধ্যে হাকার করলেও অসহায় সে। আবার যেখানে বিয়ে করবে সেখানে এই ছেলেকে কোনভাবেই মেনে নিবেনা। ছেলে নিয়ে তখন নতুন দুর্ভোগ শুরু হবে। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না।
নাদিয়ার বিয়ে হয়। সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয় তাকে। এদিকে মিতুলের খুব কষ্ট। সৎ মা তাকে দেখতে পারে না। অনাদরে অবহেলায় কাটে তার জীবন। শরীরে ঘা পাচরায় ভরে যায়। একদিন নাদিয়ার এক খালাতো ভাই মিতুলের এমন অবস্থা দেখে এসে ভাই রাজীবকে বুঝায়। তুই হইছস মিতুলের মামা তোকে একটু দায়িত্ব নিতে হবেই। মিতুলের বাবা বিয়ে করছে মা ও বিয়ে করছে। তারা তাদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। মাঝখান থেকে ছেলেটার হচ্ছে কষ্ট। তারা যদি সময় মতো বুঝতো তাদের এমন দশা হতো না। আবেগের বিয়ে। আজ যত কষ্ট সব ভোগ করতে হচ্ছে সন্তানকে। নাদিয়া আর জাবেদ দুজনার নতুন সংসারে নতুন অতিথি এসেছে। সেই সন্তান নিয়ে তারা ব্যস্ত। তুই মামা তোর যদি একটু কষ্টও হয় তুই ছেলেটাকে নিয়ে এসে তোর কাছে রাখ। তুই ছেলেটার লালন পালন কর। বাচ্চাটা বড় হচ্ছে কখন কোন খারাপ পথে চলে যায়। তখন কি থেকে কি হয়ে যাবে বলা যায় না। বাবা মায়ের ভুলের খেসারত দিতে হয় সন্তানকে। সন্তানের জীবনে নেমে আসে সীমাহীন দুর্গতি। আবেগের বশবর্তী হয়ে কোন কিছু করতে নিষেধ করা হলেও তারা সেটাই করে। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার বুদ্ধি সামর্থ্য কোনটাই তাদের থাকেনা।
অপরিণামদর্শী জীবনের বিড়ম্বনা থেকে জীবনকে রক্ষা করতে পারে সামাজিক সুরক্ষা। আমাদের সমাজে গড়ে উঠুক সেই সুরক্ষা। নিরাপদ হোক নবীন জীবন।
সাহিত্য/হান্নান