ছোটগল্প: শেষ থেকে শুরু

সুলেখা আক্তার শান্তা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৬:৫৫ অপরাহ্ণতুমি এত কিছু কিভাবে একা সামলাও বুঝিনা! অফিস কিংবা বাসা। কোন কিছু করতে চাইলে আমাকে করতে দাও না। সারাদিন তুমি অফিস করো তারপরও যদি তোমাকে বাসার কাজ করতে হয়, এটা কি ভালো হয়? তুমিও তো অফিস করো? অফিস করে এসে আবার বাসার কাজ করো সেখানে আমি একটু সাহায্য করলে কী হয়। যেটুকু কাজ বুয়াই করে দেয়। আমি শুধু একটু রান্নাটা করি। সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা দেখি। স্বামী স্ত্রীর পরস্পর পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান একে অপরের পরিপূরক। কথাটা তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। একজন আরেকজনের প্রতি বোঝাপড়াটা খুব ভালো। রাকিব আইরিন দু’জনই চাকরিজীবী। অফিস টাইমে পর যে সময়টুকু থাকে দু’জনেই বাসায় কাটাতে ভালবাসে। বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে দু’জনে ভালোবাসার গল্পে মেতে ওঠে। তাদের আচার-আচরণ এমন ছিল যেন দু’জন নতুন করে প্রেমে পড়েছে। এ প্রেম ভালোবাসা শেষ হবার নয়। মেয়ে রাফা বাবা মায়ের চোখের মনি। মেয়ের স্বপ্ন সাজাতেই দু’জনে ব্যাকুল। ছোট ভাই সোলেমানের আগমন বড় ভাই রাকিবের বাসায়। তার শহর ভাল্লাগেনা, গ্রামে থাকতে সে বেশি ভালোবাসে। আইরিন খুশি সোলেমানের আগমনের কারণে। দেবরের প্রতি অধিকার নিয়ে বলে, এইবার তুমি যেতে পারবা না, এখানেই থাকবা। বাড়িতে থাকো সেখানে কি খাও না খাও চোখে তো আর দেখিনা। ভাবী আমারে নিয়ে চিন্তা করেন না, আমি সেখানে ভালোই আছি। আমার এই শহর ভালো লাগে না। এখানে বিল্ডিং এর গাদাগাদি দেখে মনে হয় বিল্ডিং এসে যেন ঘাড়ের উপর পড়বে! গ্রামে খোলা পরিবেশ প্রাণ খুলে শ্বাস নিতে পারি। এখানে মনে হয় বন্দী হয়ে আছি। তোমার যে কথা, এখানে আমরা থাকি না! কত মানুষের বসবাস তারা কিভাবে থাকে? হেসে বলে, তাদের ভালো লাগে তারা থাকে আমার তো ভালো লাগে না। তোমার ভাস্তিটা চাচু কবে আসবে চাচু কবে আসবে করে পাগল হয়ে যায়। চাচাকে তো দেখিনা তেমন পাগল হতে ভাস্তির জন্য। ওর জন্য আমারও খারাপ লাগে। রাফা এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল কথা। চাচু এখন থেকে কিন্তু তুমি আমাদের এখানে থাকবা আর যেতে পারবা না। ঠিক আছে মামনি আমি থাকবো।
সত্যি বলছো?
ওরে বাবা মেয়ে আমার বলে, সত্যি বলছো! একটা কাজ করা যায় না মামনি, তুমি আমার সঙ্গে গ্রামে থাকবা।
থাকতে তো চাই কিন্তু আমার স্কুল আছে যে।
ঠিক আছে মামনি পড়াশুনা শেষ করার পরে আমাদের ওখানে গিয়ে থেকো। আর স্কুল ছুটি পেলে যাবে।
আইরিন আলাপ করে রাকিবের সঙ্গে। সোলেমানের বিয়ে করিয়ে দাও। এভাবে একা একা কতকাল থাকবে। আমার অফিস করে নাভিশ্বাস। আমি কিভাবে কী করব। শোনো ছোট ভাই বোন থাকলে তাদের ভালো-মন্দের দায়িত্ব নিতে হয়। তোমার ভাইয়ের জন্য এখন যা কিছু করার তোমারই করতে হবে। ছুটি নিয়ে মেয়ে দেখে ভাইকে বিয়ে করিয়ে আসবা। তুমি ঠিকই বলেছ। সোলেমানকে এখন বিয়ে করানো দরকার। ওর একটা সংসার হোক। রাকিব কাজের ফাঁকে ফাঁকে সোলেমানের জন্য পাত্রীর খোঁজ করে বিয়ের সব আয়োজন সম্পন্ন করে। একদিন শুভ লগ্নে সোলেমানের সঙ্গে দীপার বিয়ে হয়।
রাকিবের রিটায়ারমেন্টের সময় ঘনিয়ে এসেছে। মনে মনে ভাবে অবসর জীবনটা কিভাবে কাটাবে। শরীর স্বাস্থ্য তার আগাগোড়াই ভালো। বড় ধরনের কোন অসুস্থতা নাই। গ্রামের পারিবারিক সম্পত্তি যা আছে তাতে স্বাচ্ছন্দে চলে যাবে। দীর্ঘ চাকরি জীবনে পৈতৃক সম্পত্তির তত্ত্ব তালাশ নেওয়া সম্ভব হয়নি। সেই কারণে এখন প্রায়ই বাড়িতে যেতে হয় তাকে। আইরিন স্বামীকে বলে, একটি মাত্র মেয়ে আমাদের। আমরা যাই কিছুই করি এই ময়মনসিংহ শহরেই করি। আমাদের অবর্তমানে মেয়ের পক্ষে কি গ্রামে গিয়ে সম্পত্তির খোঁজ খবর করা সম্ভব হবে। সম্পত্তি এত জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখার কি দরকার। এমনিতেই আমাদের গ্রামে পৈতৃক সম্পত্তি আছে তারপর নতুন কিছু করার দরকার নেই। আমাদের মেয়ে কি পারবে এত কিছু ঠিক রাখতে? রাকিব নিচু স্বরে বলে, সম্পদ করা তো দোষের কিছু না। রাকিবকে আগে কখনো অফিস কামাই করতে দেখা যায়নি। এখন সে অফিস থেকে ঘন ঘন ছুটি নেয়। তার এখন শহর ভালো লাগে না। সে এখন গ্রামে চলে যায় সেখানে গেলে আসতেও চায় না।
রাকিব এক সময় লক্ষ্য করে তার থাকার জন্য নিজস্ব কোন ঘর নাই। নিজের স্বাচ্ছন্দ্য মতো থাকতে হলে একটা ঘর দরকার। সে সিদ্ধান্ত নেয় বাড়িতে বিল্ডিং তুলবে। আইরিন অবাক হয়ে বলে, তুমি বাড়িতে বিল্ডিং তুলবে? যে বিল্ডিং আছে সেটাতেই থাকার মানুষ নাই। নতুন করে আবার করার কি আছে! আমি ওখানে গিয়ে থাকছি অথচ আমার নিজস্ব থাকার জায়গা নাই। আমার সামর্থ্য না থাকলে না হয় এখানে ওখানে থাকা যেত। আমি যখন ওখানে গিয়ে থাকছি তখন আমার থাকার নিজস্ব জায়গা করলে ক্ষতি কি। আইরিনের আর তর্ক করতে ইচ্ছা করে না। তোমার যা ভালো মনে হয় তুমি তাই করো। রাকিব বাড়িতে বিল্ডিং কাজ শুরু করে। ছোট ভাই সোলেমানের ঘরের লাগোয়া জমিতে। আইরিন কী বলবে স্বামীর ইচ্ছা মেনে নেয়। এরমধ্যে রাকিব অবসর গ্রহণ করেছে বিপুল অংকের অবসরকালীন প্রাপ্য টাকা সহ। অধিকাংশ সময় সে গ্রামে থাকে। আইরিনকে মেয়ের পড়াশোনা এবং সবকিছুই দেখতে হয়।
দীপার মেয়ে হয়েছে। সেটা নিয়ে রাকিব ব্যস্ত এবং উদ্বিগ্ন। এদিকে নিজের মেয়ে রাফার কোন খোঁজ খবর নেই। আইরিনের উপর সব দায়িত্ব চাপিয়ে সে নিশ্চিন্ত। নিজের সন্তান রেখে অন্যের সন্তান নিয়ে খুব নাচানাচি করছ। সেটা করো কিন্তু নিজের প্রতি দায়িত্বটা ঠিক রাখো। তুমি আছো তাই নিশ্চিন্তে আছি। দেখি সবকিছু তুমি পারো। পৈত্রিক সম্পদ ছাড়াও রাকিব নিজের অর্থায়নে সম্পদ সম্পত্তি করছে। রাকিবের সম্পত্তিতে অধিকার দেখায় সোলেমানের উচ্চাভিলাসী স্ত্রী দীপা। জীবন সম্পর্কে ভিন্নতর ধারণা ছিল তার। সে মনের মধ্যে যে ধারণা গুলো সাজিয়ে রেখেছিল তার সঙ্গে কোন কিছু মেলাতে পারিনি। ইচ্ছা ছিল তার বিয়ে হবে ঝলমলে এক শহরের সমৃদ্ধ কোন পরিবারে। জীবন অথবা সংসারের কোন সংকট তাকে স্পর্শ করবে না। তার বদলে তার জীবন কাটছে গ্রামের নিশ্চল অন্ধকারে। কি এক অদৃশ্য কারসাজিতে নিজের স্বামীকে করেছে অনুগত। স্ত্রীর প্রতি অনুরক্ত স্বামীকে ‘স্ত্রৈণ’ বলা হয় এটা সবার জানা কিন্তু বিষয়টি তার চেয়ে বাড়াবাড়ি রকমের। স্বামীর বড় ভাই হলেও শহর থেকে আসা রাকিবের উপর ছিল দীপার বিশেষ দৃষ্টি। যে কোন প্রয়োজনে চোখের পলকে সবার আগে এসে হাজির হয় দিপা। আইরিনের এইটা নিয়ে চিন্তা। আপন মানুষ অধিকার দেখাতে পারে কিন্তু এত অধিকার দেখানো চিন্তার ব্যাপার। সোলেমান এবং তার স্ত্রী দীপা রাকিবের নিজ অর্থে যে সম্পত্তি করেছে তার ভাগ চায়। তাদের যুক্তি পৈতৃক সম্পত্তির আয় থেকে এসব সম্পত্তি করা হয়েছে। রাকিব কিছু না বললেও আইরিন তার প্রতিবাদ করে। কেন এটার ভাগ হবে এটা আমার স্বামী নিজ অর্থে করছে। সেটার ভাগ কেন হবে? বরাবরের মতো রাকিব নিশ্চুপ থাকে। প্রতিউত্তর আশা করে আইরিন। তোমার ভাই আর তার বউ তোমার সম্পত্তির আশা করে কেন? রাকিবের কোন কথা নেই। রিটায়ারমেন্টের বড় অংকের টাকার বিষয়টি দীপা অবগত। সেখানে সেই রিটায়ারমেন্টের টাকার আশা দীপার। আইরিন হতাশার উপর হতাশ। এটা তো ভালো লক্ষণ না। তোমার এখানে চুপ হয়ে থাকার কারণ কি? তাতেও রাকিবের মুখ থেকে কথা বের হয় না। আইরিন স্বামীকে বলে, তোমার কোন কিছুরই আশা ভরসা করি না আমি। তোমার সম্পদ তোমার বাড়ি তোমার পেনশনের টাকা যার অগ্রাধিকার সে তো হচ্ছে তোমার ছোট ভাইয়ের বউ দীপা। আইরিনের খুব রাগ হয়, তার স্বামীর কাছে কোন কথা বলে উত্তর পায় না। আমিও আর কোন ব্যাপারে কোন কিছু বলতে চাই না।
রাকিব কিছুদিন ধরে গ্রামে আছে। কোন খোঁজ খবর জানতে না পারায় আইরিন ভাবে সে আমার স্বামী যাই তাকে নিয়ে আসি। আইরিন গ্রামে আসে স্বামীকে নেওয়ার উদ্দেশ্যে। আইরিন বাড়ি আসায় সবার মুখটা যেন একটু মলিন দেখায়। আইরিন তা বুঝতে পেরে। এ নিয়ে তার কোন মাথা ব্যাথা নেই। আমি তো আর এখানে থাকতে আসিনি, এসেছি রাকিবের জন্য রাকিবকে নিয়ে চলে যাব। হঠাৎ করে আইরিনের একটা বিশেষ বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি যায়। সে গভীরভাবে লক্ষ্য করে দেখে সোলেমানের মেয়েকে। মেয়েটি দেখতে হুবহু তার মেয়ে রাফার মতো। মুখ, সেই চোখ, সেই নাক, সেই মুখের গঠন। ধীরে ধীরে ঘটনার পর ঘটনা সাজিয়ে তার মানস পটে ভেসে উঠে প্রকৃত চিত্র। আইরিনের মাথা ঘুরে যায়। আমি তো মানতে পারছি না। আর আমি যা বুঝার বুঝে গেছি এই জন্যই রাকিব এখানে থাকে। তাকে আটকে রেখেছো কুকীর্তি প্রকাশের হুমকি দিয়ে। ব্ল্যাকমেইলিং এর কঠিন জালে আটকে রেখেছো তোমরা। আমার স্বামী আমার কাছ থেকে দূরে থাকবে। আমি ওর কাছ থেকে দূরে থাকবো। ভালোবাসা থেকে স্বামীর অধিকার থেকে তুমি আমাকে এইভাবে দূরে রাখলে! কান্নায় বুজে আসে তার কণ্ঠস্বর। আমার উপর তোমার যে অধিকার সেই অধিকার তো আমি কাউকে দেইনি। তাহলে তোমার উপর যে অধিকার আমার তুমি কেন সেই অধিকার অন্যকে দিলে।
রাকিব তার ঘরে জানালার কাছে বসে আছে। রাকিব আর দিপা দু’জন জাললায় বরাবর দু’জন দু’জনের দিকে তাকায়। আইরিন জানালার পর্দা টেনে ছিঁড়ে ফেলে। এই দৃশ্য কেন আমার দেখতে হলো? জীবনের শেষ বেলায় এসে সব লন্ডভন্ড করে দিলে। থাকো তুমি এখানে আমার আর আমার মেয়ের কথা তোমার ভাবতে হবে না। যে প্রদীপ হাজার জনকে আলো দেয় সেই প্রদীপের দরকার নেই। প্রদীপ ছাড়াই চলবো আমি একা পথের পথিক হয়ে।
সাহিত্য/হান্নান