‘বঙ্গভ্যাক্স’ স্বাস্থ্যখাতের গেম চেঞ্জার হয়ে যেতে পারে : ডা.মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল
সিকডে
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ জুলাই ২০২২, ৫:২৭ অপরাহ্ণ
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব, প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর, বঙ্গভ্যক্স ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলোজি বিভাগের প্রধান।
বঙ্গভ্যাক্সের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল কবে শুরু হচ্ছে? কতোজনের ওপর ট্রায়ালটি হবে? কোথায় হবে এই ট্রায়াল?
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল : বঙ্গভ্যাক্স ট্রায়ালের জন্য এখন আমরা ভলান্টিয়ার নিয়োগ করবো। ৬০ জন্য ব্যক্তি দুটি ভাগে ভাগ করা হবে। ৩০ জনের বয়স হবে ১৮-৫৫, অপর ৩০ জনের বয়স ৫৫ বা তারও বেশি। তাদের ২১ দিনের বিরতিতে দুই ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। ভ্যাকসিন নেওয়ার পর একদিন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ে পর্যবেক্ষণে থাকবেন, যেখানে ট্রায়াল অনুষ্ঠিত হবে। সকলের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ইনসুরেন্স নেওয়া আছে। তারা সাধারণ মানুষ, স্বাস্থ্যকর্মী নন।
কতোদিন পর প্রাথমিক ডাটা দিতে পারবেন? বঙ্গভ্যাক্সের কোনো সাইডএফেক্টের শঙ্কা করছেন কি?
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল : আমরা বিশ্বাস করি, বঙ্গভ্যাক্সের কোনো রকম সাইড এফেক্ট হবে না। কারণ বানরে আমরা দেখেছি এটি শতভাগ কার্যকর। কোনো রকম সমস্যা হয়নি। তাছাড়া এরই মধ্যে পৃথীবিতে বহু কোটি মানুষ এরই মধ্যে এমআরএনএ ভ্যাকসিন পেয়েছেন। তারপরও আমাদের সকল প্রস্তুতি থাকবে। ভ্যাকসিনের র-মেটারিয়াল আমদানি, ভ্যাকসিন তৈরি, ভলান্টিয়ার রিক্রুট করে ট্রায়ালটি সেপ্টেম্বর মাসের শুরু হবে বলে আশা করছি । ট্রায়াল শুরু হওয়ার ৩৫ দিন পর তা শেষ হবে। আমরা আশা করছি, অক্টোবরের মধ্যে দেশে উদ্ভাবিত ও উৎপাদিত প্রথম এমআরএন ভ্যাকসিনের প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত পেয়ে যাবেন দেশবাসী।
কবে নাগাদ বঙ্গভ্যাক্স বাজারে আনতে পারবেন বলে মনে করেন আপনারা?
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল : ট্রায়ালের ফেজ-১, ফেজ-২ ও ফেজ-৩ সম্পন্ন করার পর ভ্যাকসিন বাজারে আসবে। তবে অনেক ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, ফেজ-৩ চলাকালীন সময়ে ভ্যাকসিন বাজারজাতের সরকারি অনুমোদন পেয়ে গিয়েছিলো। যেটি আমরা ভারত, আমেরিকা ও রাশিয়ায় দেখেছি। যদি আমাদের ভ্যাকসিন করোনার বিরুদ্ধে কার্যকর হয়, তাহলে ২০২৩ সালের মাঝামাঝি নাগাদ বাংলাদেশের মানুষ তার প্রথম ভ্যাকসিনটি পেয়ে যাবেন দেশবাসী।
বঙ্গভ্যাক্সের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের দীর্ঘ অপেক্ষা নিয়ে মানুষের মধ্যে অনেক প্রশ্ন। ট্রায়ালের অনুমোদন পেতে এতো সময় লাগলো কী কারণে? বাণিজ্যিক কোনো কারণ? জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোনো কারসাজি ছিলো?
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল : আমি জানি অনেকের মধ্যেই প্রশ্ন আছে, ভ্যাকসিনটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদনে এতো সময় লাগলো। কেন এতো দেরী হলো? এখানে কি কোনো দেশি বা আন্তর্জাতিক চক্রান্ত ছিলো কিনা। এ নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। এখনো হচ্ছে। কিন্তু আমি সেরকম কিছু ছিলো বলে মনে করি না। আমি মনে করি, যথার্থ সময়েই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন পেয়েছে বঙ্গভ্যাক্স। ন্যাসভ্যাক নামে একটি ওষুধ উদ্ভাবনের সঙ্গে আমি জড়িত আছি। ওষধুটির রেজিস্ট্রেশন দিতে সরকার বা ওষুধ প্রশাসনের তিন বছর সময় লেগেছে। কারণ কী? কারণ আপনি যখন বলবেন, আপনি একটি ওষধু উদ্ভাবন করেছেন, মানুষের শরীরে প্রয়োগ করতে চান, তখন তা একটি প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে যেতে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ’র যে সক্ষমতা, আমাদের ওষুধ প্রশাসনের সেই সক্ষমতা নেই। ন্যাসভ্যাকের রেজিস্ট্রেশন দিতে চার বছরের মতো সময় লেগেছিলো। বঙ্গভ্যাক্সের বেলায় তার চেয়ে কম সময় লেগেছে, কারণ আমাদের সক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক বেশি।
করোনা মহামারি তো এখনো মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে। কী কাজে লাগবে এখন এই ভ্যাকসিন? আদৌ কোনো কাজে লাগবে কি?
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল : বিশ্বের নবম দেশ হিসেবে আমরা এমআরএন-এ ভ্যাকসিন তৈর করছি। এটাও কিন্তু ধাতস্থ, আতস্থ বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপার ছিলো। এছাড়া আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ ছিলো। ছিলো অভ্যন্তরীণ নানান চ্যালেঞ্জও। আজকে ফাইজার বা মডার্নার তিন ডোজ ভ্যাকসিন নিয়েও করোনা হচ্ছে মানুষের। ভ্যাকসিন নেওয়ার পর করোনা হলেও আমরা মেনে নিচ্ছি। আজকে যদি বঙ্গভ্যাক্সের বেলায় এটি ঘটতো, কী বলা হতো? একদল লোক বলতো, এটি একটি আওয়ামী চক্রান্ত। পানি ভরে ভরে মানুষকে দিচ্ছে। যেমনটি তারা একসময় কোভিশিল্ডের বেলায় বলেছে। ফলে আমি মনে করি, সরকার বিজ্ঞান, সক্ষমতা, পারিপাশির্^কতা ইত্যাদি বিবেচনা করে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে। আর এমআরএন’এ ভ্যাকসিনের সময় শেষ হয়ে যায়নি, মাত্র শুরু।
বঙ্গভ্যাক্স কেন বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল : বঙ্গভ্যাক্স বিশে^র নবম দেশ, যারা এমআরএন ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করতে যাচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে বিশে^ দুই থেকে তিনটি এমআরএন’এ ভ্যাকসিন মার্কেটে আছে। সে বিবেচনায় বাংলাদেশের বঙ্গভ্যাক্স অসম্ভব বড় সক্ষমতার উদাহরণ। বঙ্গভ্যাক্স আমাদের স্বাস্থ্যখাতের জন্য গেম চেঞ্জার হয়ে যেতে পারে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে সামনে রেখে আমাদের যে প্রস্তুতি, বঙ্গভ্যাক্স সফল হলে তা বড় একটি হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে।
বঙ্গভ্যাক্সের বিশেষত্ব কী যে, এখনো এই ভ্যাকসিনের সম্ভাবনা আছে।
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল : বঙ্গভ্যাক্স করোনার ডেল্টার ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে শতভাগ কার্যকর। অমিক্রমনের বিরুদ্ধেও কার্যকর। অর্থাৎ ভাইরাসের চেহারা বদলাতে পারে। নতুন ভাইরাস আসতে পারে, কিন্তু আপনার যদি এমআরএনএ টেকনোলজি থাকে, আপনি সে অনুযায়ী ভ্যাকসিন ডিজাইন করতে পারবেন। শুধু ভাইরাসের সিকুয়েন্স জানার দরকার পড়বে। এমআরএন ভ্যাকসিনের আরেকটি বড় গুণ হচ্ছে আপনি ইনডিভিজুয়াল ক্যানসার ট্রিটমেন্টেও যেতে পারবেন।
ধরুন আবুল সাহেবের লিভার ক্যানসার আছে, কাবুল সাহেবেরও লিভারে ক্যানসার আছে। আমরা এখন আবুল-কাবুল সাহেবদের একই ধরনের কেমোথেরাপী দিয়ে চিকিৎসা করছি। তবে সামনে যে পরিবর্তনটা আসবে, আমরা আবুল সাহেবের জেনেটিক সিকুয়েন্সিং করবো। তার কোথায় জিন নিউটেশন আছে, তার জন্য আমরা আলাদা ওষুধ তৈরি করবো। কাবুল সাহেবের জন্যও আলাদা ওষুধ তৈরি করা হবে। যদি আপনার কাছে এমআরএন টেকনোলজি থাকে, তাহলে আপনি আবুল ও কাবুল সাহেবদের জন্য আলাদা ওষুধ তৈরি করতে পারবেন। এটাকে থেরাপিউটক ভ্যাকসনি বলা হয়। এটি রূপকথা বা কল্পকাহিনি নয়। এমআরএন ভ্যাকসিন শুধু কোভিডের ভ্যাকসিন নয়, এটি বিরাট এক সক্ষমতা। বাংলাদেশ নবম দেশ বিশ্বে যারা এমআরএন টেকনোলজিকে এখন ট্রায়ালে নিয়ে যাচ্ছে। আগে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ভারত, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, এ কয়েকটি দেশ এ কাজটি করতে সক্ষম হয়েছে।
বঙ্গভ্যাক্সের সম্ভাবনা ঠিক কোন জায়গায় দেখছেন আপনি?
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল : করোনা মহামারি এখনো শেষ হয়নি। বিশ্বে এখনো কোভিড আছে। দেশে দেশে সংক্রমণ বাড়ছে, কোথাও কোথাও কমছে। কিন্তু সহসা বিদায় নিচ্ছে তা প্রতিয়মান হচ্ছে না। করোনার জন্য নিয়মিত বুস্টার ডোজ নিতে হতে পারে। কারণ এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট ও জাপানে ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের চতুর্থ ডোজ দেওয়া শুরু হয়ে গেছে। ইসরায়েল তার পুরো জনগোষ্ঠীকে চতুর্থ ডোজ দিয়ে ফেলেছে। আমরা জানি, করোনা ভ্যাকসিনের জন্য ৪০ হাজার কোটি টাকা ইতোমধ্যেই খরচ হয়ে গেছে। বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতা ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিচেনায় আর কতোদিন বিনা পয়সায় আমরা তা দিতে পারবে, সেটিও একটা বিরাট চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। আমরা আশা করতে পারি না, সরকার আমাদের সারাজীবন বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দিয়ে যাবে। বঙ্গভ্যাক্স দেশের ভ্যাকসিন। এটি বুস্টার ডোজ হিসাবে কাজে লাগতে পারে। দেশে তৈরি ভ্যাকসিন, দামও কম হবে। পাশাপাশি যদি সরকার কোনো সময় মার্কেট উন্মুক্ত করে দেয় আর বঙ্গভ্যাক্স যদি কার্যকর প্রমাণিত হয়, তখন এটি মহামারি মোকাবেলায় বড় ভূমিকা রাখবে।
বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধিতে বঙ্গভ্যাক্স কীভাবে কাজ করবে বলে মনে হয় আপনার?
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল : যে প্লান্টে বঙ্গভ্যাক্স তৈরি হচ্ছে, আমি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে বিশ্বাস করি এটা খুব দ্রুত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারও অনুমোদন পাবে। সেক্ষেত্রে এই ভ্যাকসিন রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করতে আমরা সক্ষম হবো। বিশে^র অনেক দেশই এখনো খুব কম ভ্যাকসিনই পেয়েছে। সেই জায়গায় বড় সুযোগ বঙ্গভ্যাক্সের সামনে। ট্রায়াল শেষ করতে পারলে, বহু দেশে এই ভ্যাকসিন রপ্তানি করা যাবে।