সায়ানাইডের চেয়েও ভয়ঙ্কর পটকার বিষ, একটির বিষে ৩০ জনেরও মৃত্যু হতে পারে
সিলেটের কন্ঠ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ৯:৫৯ অপরাহ্ণঅনলাইন ডেস্ক:
সিলেটের বাজারগুলোতে প্রকাশ্যেই বিক্রি হয় পটকা। গ্রামাঞ্চলে আরো বেশি হয়। অপেক্ষাকৃত কম দামে পাওয়া যায় বলে দরিদ্র পরিবারগুলোতে এর চাহিদাও রয়েছে। মাছের বিকল্প হিসেবে পটকা খাওয়া হয়। সিলেট অঞ্চলে পটকাকে ফুটকোনা বা ফুটকা নামে ডাকা হয়।
এই পটকা খেয়েই মঙ্গলবার সিলেটের জৈন্তাপুরে মারা গেছেন পাঁচজন। আরো অন্তত ১২ জন আহত অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। তাদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পটকা কোনভাবেই খাওয়া উচিত নয়। পটকার মধ্যে “টেকটাডোটক্সিন” নামক এক ধরণের বিষ থাকে। একটি পূর্ণাঙ্গ পটকা মাছের বিষে ৩০ জন মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে।
জানা যায়, পটকা মাছ এক ধরণের মাছ। আর এর বিষ সায়ানাইডের চেয়ে ১ হাজার ২০০ গুণ বেশি বিষাক্ত। একটি পূর্ণাঙ্গ পটকা মাছের বিষে ৩০ জন মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে।
এ মাছ খাওয়া কোনোভাবেই নিরাপদ নয় বলে দীর্ঘদিন ধরেই এর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি রেখেছেন মৎস বিজ্ঞানীরা। এর আগেও মৎস অধিদপ্তর এ মাছের বিষাক্ততা সম্পর্কে জনসচেতনতামূলক বিজ্ঞাপনও প্রচার করেছে।
মৎস্যবিজ্ঞানীরা জানান, টেট্রাওডোনটাইড (Tetraodontidae) পরিবারের এ মাছের ইংরেজি নাম পাফার ফিশ। জাপানে পটকাকে বলা হয় ফুগু (Fugu)। বাংলাদেশে সাধারণত সাদুপানির ও লোনাপানির−এই দুই ধরনের পটকা মাছ পাওয়া যায়। সাদু পানির পটকা আকারে লোনাপানির পটকার চেয়ে অনেক ছোট হয়।
মৎস্যবিজ্ঞানীরা আরও জানান, ‘আমাদের দেশে সাদুপানিতে এ পর্যন্ত দুই প্রজাতির পটকা পাওয়া গেছে। এদের বৈজ্ঞানিক নাম টেট্রাওডন কটকটিয়া (Tetraodon cutcutia ও চেলোনোডন পাটুকা (Chelonodon patoca)। জাপান সমুদ্রে এ পর্যন্ত ২১ প্রজাতির পটকা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৪ প্রজাতিই বিষাক্ত। বাংলাদেশেও সামুদ্রিক পটকার প্রজাতির সংখ্যা ২০ বা এর কাছাকাছি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, পটকা মাছের ওপর বাংলাদেশে গবেষণা হয়নি বললেই চলে। তবে এ দেশের দুজন মৎস্যবিজ্ঞানী জাপানে পটকা মাছের ওপর পিএইচডি করেন।
এঁরা হলেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. হারুনুর রশীদ। ড. ইয়াহিয়া পটকা মাছের বিষাক্ততার ওপর এবং দ্বিতীয়জন রিপ্রোডাকটিভ ফিজিওলজি (প্রজননসংক্রান্ত বিষয়) নিয়ে কাজ করছেন।
এই দুই বিজ্ঞানী জানান, পটকা খেয়ে জাপানে সবচেয়ে বেশি লোক মারা যায়। এ ছাড়া কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, চীন, মেক্সিকো, বাংলাদেশসহ অনেক দেশে এই মাছ খেয়ে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। জাপানিদের কাছে এটি অত্যন্ত সুস্বাদু ও অভিজাত খাবার। অনেক জাপানি পটকাকে কাজের উদ্যম সৃষ্টির প্রতীক হিসেবে মনে করে। তবে কেবল লাইসেন্সধারী অভিজ্ঞ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান প্রক্রিয়াজাত করে এই মাছ বিক্রি করে থাকে।
দুই বিজ্ঞানী জানান, পটকার চামড়া, যকৃৎ ও ডিম্বাশয়ে সবচেয়ে বেশি বিষ থাকে। নাড়িভুঁড়ি, রক্ত ও মাংসপেশিতে বিষ থাকে কম। বর্ষাকালে প্রজননের সময় বিষের পরিমাণ বেড়ে যায়।
ড. ইয়াহিয়া জানান, গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে স্বাদুপানির দুটি পটকাই বিষাক্ত। সামুদ্রিক পটকার ওপর কোনো কাজ হয়নি বলে এ বিষয়ে কোনো তথ্য জানা নেই। বাসস্থান, প্রজাতি ও ঋতুভেদে পটকার বিষের তীব্রতা ভিন্ন হয়। বৈশাখে যে পটকা বিষাক্ত, কার্তিকে সেটি বিষহীন হতে পারে। সামুদ্রিক পটকার চেয়ে সাদুপানির পটকা অধিকতর বিষাক্ত।
মৎস্যবিজ্ঞানীরা জানান, পটকার শরীরে প্রথম অবস্থায় কোনো বিষ থাকে না। পটকা সর্বভুক প্রাণী। খাদ্য শিকারের মাধ্যমে পটকার দেহে ধীরে ধীরে বিষ ঢোকে। এ ক্ষেত্রে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। পরে তা পটকার দেহের বিভিন্ন অংশে জমা হয়। এ বিষে পটকা আক্রান্ত না হলেও বিভিন্ন রাক্ষুসে প্রাণীর হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য এসব বিষ নিঃসরণ করে।
ড. হারুন জানান, পটকা মাছের বিষ সায়ানাইডের চেয়ে প্রায় এক হাজার ২০০ গুণ বেশি বিষাক্ত। রান্না করলে পটকা মাছের বিষ নষ্ট হয় না। অত্যধিক তাপে কেবল বিষের রাসায়নিক কাঠামো রূপান্তর হতে পারে।
ড. ইয়াহিয়া বলেন, আমাদের দেশে সাধারণত গ্রামের দরিদ্র মানুষ পটকা খায়। পটকার বিষ অম্লীয় মাধ্যমে বেশি ক্রিয়াশীল হয়। খালি পেট অম্লীয় হয়। তাই অর্ধাহারে-অনাহারে থাকা দরিদ্র মানুষ পটকা খেলে বিষক্রিয়া বেশি হয়।
মৎস্য বিশেষজ্ঞরা জানান, সাদুপানি ও লোনাপানির পটকার বিষাক্ততার লক্ষণ রোগীর দেহে প্রায় একই রকম। পটকা মাছের বিষে এক ঘণ্টার মধ্যে প্রথমে রোগীর ঠোঁট ও জিহ্বায় জড়তা এবং পর্যায়ক্রমে মাথাব্যথা, বমি বমিভাব, মুখে শুষ্ককতা, মাংশপেশিতে ব্যথা ইত্যাদি নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে। ধীরে ধীরে রোগী পক্ষাঘাতগ্রস্ত হতে থাকে। চার থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে শ্বাসকষ্টে মৃত্যুও হতে পারে।
ড. ইয়াহিয়া ও ড. হারুন বলেন, কোনোভাবেই পটকা মাছ খাওয়া নিরাপদ নয়। তাই পটকা মাছ খাওয়া থেকে বিরত থাকাই বাঞ্ছনীয়। এ জন্য প্রচার চালিয়ে সরকারকেই গণসচেতনতা বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক ড. মো. আবদুল ওহাব বলেন, ‘পটকা মাছ বাজারে বিক্রি বন্ধে আইন করতে হবে। আইন অমান্যকারীর সাজা ও অর্থদন্ড রাখতে হবে।
তবে সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন পটকা কোনো মাছ নয়। তিনি বলেন, পটকা কোনো মাছ নয়। এটি বিষযুক্ত একটি জলজপ্রাণী। পটকার কানের কাছে গ্রন্থিতে বিষ থাকে। পটকা খেলে বিষক্রিয়া হতেই পারে। এটি খেলে কেউ মারাও যেতে পারে।
সূত্র : প্রথম আলো
. . . . . . . . .