সিলেট ও চট্টগ্রাম দিয়ে মানবপাচার দিন দিন বেড়েই চলছে
সিলেটের কন্ঠ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ অক্টোবর ২০১৬, ১২:০২ পূর্বাহ্ণডেস্ক রিপোর্ট :
দুর্নীতিগ্রস্ত ট্রেভেলস এজেন্সি, দালাল চক্র ও সংশ্লিষ্ট অসাদু কিছু কর্মকর্তাদের ছত্রছায়ায় সিলেট ও চট্টগ্রাম দিয়ে মানবপাচার দিন দিন বেড়েই চলছে। ‘মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন’-এর কার্যকরী কোন পদক্ষেপ না থাকায় এমটি হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পাচার হওয়া মানুষজন ভারতের বিভিন্ন কারাগারে মানবেতর জীবনজাপন করছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
সম্প্রতি কানাইঘাট লক্ষীপ্রসাদ পূর্ব ইউপির সীমান্তবর্তী দনা এলাকা দিয়ে ভারতে মানব পাচার বৃদ্ধি পেয়েছে। একটি চক্র বিভিন্ন কাজের প্রলোভন দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভারতে নারী-পুরুষ ও শিশুদের পাচার কলে চলেছে। গত কদিনে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে অবৈধ ভাবে ভারতে পাচারকালে ১৩ জনকে কানাইঘাট দনা বিজিবি ক্যাম্পের জওয়ানরা আটক করে।
বিজিবির হাতে আটককৃতরা হলেন, বিয়ানীবাজার উপজেলার বৈরাগী গ্রামের নিজাম উদ্দিনের পুত্র আনোয়ার হোসেন, একই গ্রামের রিয়াজুল হকের স্ত্রী ফরিদা বেগম, আনোয়ার হোসেনের শিশু মেয়ে সুলতানা বেগম ও পুত্র সামছুল হোসেন, ইমরান হোসেন, রোকশানা, রিয়াজুল হকের মেয়ে আয়শা সিদ্দিকা, আয়শা সিদ্দিকার শিশু পুত্র সালমান হোসেন।
পরে তাদের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সাজা ও জরিমানা করা হয়। আটককৃতরা জরিমানার টাকা পরিশোধ করে মুসলেখার মাধ্যমে ছাড়া পায়। দাললরা এদেরকে লোভনীয় কাজের প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে পাচারের চেষ্টা করেছিল বলে দনা বিজিবি ক্যাম্প সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে, ভারতের শিলচর কারাগারে শিশু ও মহিলাসহ আটক ১০ বাংলাদেশী নাগরিক বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ভোগ করার পর তাদেরকে ফেরত পাঠিয়েছে ভারত।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে জকিগঞ্জ কাস্টম্স ঘাট দিয়ে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়।
তাদের মধ্যে রয়েছে জকিগঞ্জ পৌর এলাকার হোসনাবাদ গ্রামের জয়দেব লালের ছেলে বাসুদেব রায়, শান্তি লাল বিশ্বাসের মেয়ে অর্চনা বিশ্বাস ও তার শিশু পুত্র গোবিন্দ বিশ্বাস, গোপাল বিশ্বাস, সুলতানপুর ইউনিয়নের খাদিমানের সিদ্দেক আলীর ছেলে আনোয়ার হোসেন, বারঠাকুরী ইউপির উত্তরকুল গ্রামের আব্দুল মান্নানের ছেলে শামিম আহমদ, সোনাসার গ্রামের আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে শাবলু আহমদ, কানাইঘাটের দনা নয় গ্রামের রইছ আলীর ছেলে বুরহান উদ্দিন, কসকনপুর ইউনিয়নের আইয়র গ্রামের মতছিন আলীর ছেলে এনাম উদ্দিন ও মানিকপুর ইউপির মাতারগ্রামের আব্দুল হান্নানের ছেলে ওলিউর রহমান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে লিবিয়ায় মানব পাচারে জড়িত রয়েছে সিলেটের দুই ট্রাভেল এজেন্সি। র্যাব-৭ জানিয়েছে সিলেটের আল মামুন ট্রাভেলসের মালিক মো. মামুন ও শামীম ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলসের মালিক আদনান আনসারী দীর্ঘ দিন থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দর দিয়ে লিবিয়ায় মানব পাচার করে আসছে।
লিবিয়া প্রবাসী দুই বাংলাদেশির যোগসাজশে চলছে এ মানব পাচার। ভুয়া ভিসায় মানব পাচারের পুরো পক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত রয়েছে দেশের ৩০ জনের একটি দালাল চক্র। আর তাদের সহযোগিতা করছে বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনসহ বিভিন্ন শাখায় কর্মরতদের একটি চক্র। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে গত বুধবার সকালে ইমিগ্রেশনের চোখ ফাঁকি দিয়ে এয়ার এরাবিয়ার একটি ফ্লাইটে দুবাই ও তুরস্ক হয়ে লিবিয়ায় পাড়ি দিয়েছেন ২১ জন। তবে একইভাবে লিবিয়া যাওয়ার সময় বিমানবন্দর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৩৯ জনকে।
উদ্ধার হওয়া ৩৯ জনের অধিকাংশই সিলেটের বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা। উদ্ধারকৃতরা জানান, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ৮-১০ জন করে মাইক্রোবাসে করে এনে তাদের একত্র করে দালালরা। আজই তাদের লিবিয়ায় যাওয়ার কথা থাকলেও র্যাবের অভিযানে তারা আটকা পড়েন।
মানব পাচারের বিষয়টি উ্দ্বেগের সৃষ্টি করেছে। মানব পাচার চক্রের হাতে পড়ে গ্রামের সহজ সরল সাধারণ মানুষ নি:শেষ হতে চলেছে। ঝুঁকি নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করার সময় অনেকেই ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বিএসএফ-এর হাতে আটকা পড়ছেন কেউ কেউ গুলিতে রক্তাক্ত হচ্ছেন। সরকার মানবপাচারে শক্ত অবস্থানে যাওয়ার দাবি করেন প্রতারিত ও ক্ষতিগ্রস্তরা।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, সরকার মানবপাচার জিরো টলারেন্সে নামিয়ে আনার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এ জন্য প্রচলিত আইনের আলোকে নানা বিধিমালা তৈরি হচ্ছে। মানব পাচার রোধে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) সতর্ক করা হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন ইমিগ্রেশন পয়েন্টেও সতর্কতা রয়েছে। পুলিশ ও র্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্য সংস্থাগুলোও পাচারকারী চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় নিতে অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, নতুন বিধিমালা তৈরি হলে স্থানীয় পর্যায় থেকেই মানব পাচার রোধ করা যাবে। কারণ এতে বিদেশগামী বা অন্য কোথায়ও কাজের জন্য গেলে ইউনিয়ন পরিষদ বা ওয়ার্ডে তাদের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে।
নতুন বিধিমালা অনুযায়ী, মানব পাচারের শিকার ব্যক্তিদের উদ্ধার, ফিরিয়ে আনার পর পুনর্বাসন ও সুরক্ষা দেবে সরকার। তা ছাড়া মানব পাচারের মামলাগুলোর তথ্য সংরক্ষণে একটি তথ্য ভাণ্ডার বা ডাটাবেজ তৈরি হবে। এ তথ্য ভাণ্ডারে মানব পাচারের শিকার প্রত্যেক ভিকটিমের জন্য স্বতন্ত্র কোড নম্বর সংবলিত একটি ফাইল তৈরি ও সংরক্ষণ করা হবে। এতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে উদ্ধার, ফিরিয়ে আনা বা প্রত্যাবর্তন, পুনর্বাসন ও সুরক্ষা-সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষিত থাকবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নতুন বিধিমালা অনুযায়ী মানব পাচারের অপরাধে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তি বিদেশে অবস্থান করলে অথবা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে অন্য দেশে অবস্থান করলে সরকার ওই অভিযুক্তকে দেশে ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ নেবে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব প্রয়োজনীয় যোগাযোগ করা হবে। এ বিধিমালার আলোকে কোনো বাংলাদেশি নাগরিক বিদেশে পাচার হয়েছে এমন তথ্য পেলে সংশ্লিষ্ট দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশন বা দূতাবাস তার সন্ধান ও শনাক্ত করবে। ভিকটিম শনাক্ত হলে দ্রুত উদ্ধার করে দেশে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিতে হবে। মামলার কারণে ভিকটিমকে দেশে পাঠানো না গেলে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ দূতাবাস বা মিশন তাকে যথাসম্ভব আইনি সহায়তা দেবে।
. . . . . . . . .