স্বাগত ১৪২৩
সিলেটের কন্ঠ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ এপ্রিল ২০১৬, ১০:৪০ পূর্বাহ্ণজরা, গ্লানি ধুয়ে-মুছে সূচি হবে চরাচর আজ রাঙা ভোরে, পহেলা বৈশাখে। অনেক প্রত্যাশা, স্বপ্ন এ নবপ্রভাতের আগমনকে ঘিরে। প্রকৃতির রুদ্র রুপ উপেক্ষা করে বৈশাখের প্রথম দিন হয়ে উঠবে বাংলা ও বাঙালির প্রাণের উৎসব। আজ বৃহস্পতিবার, বাংলা বছরের প্রথম দিন। স্বাগত ১৪২৩।
বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, লোকজ ঐতিহ্য এবং গৌরবের উৎসবও পহেলা বৈশাখ। নববর্ষের এ উদযাপনে মিলে-মিশে আছে বাঙালি সংস্কৃতির চিরায়ত শাশ্বত-সুন্দর।
সারাদেশের অনুষ্ঠানে, পথে-ঘাটে, মাঠে-মেলায় থাকবে প্রাণের চাঞ্চল্য। আনন্দঘণ এ উৎসব ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব বাঙালিকে দেবে সুন্দর আগামীর পথের নতুন প্রেরণা। সব অপশক্তিকে রুখে দেয়ার সাহসও পাবে বাঙালি নববর্ষের প্রথম এ দিনে।
নববর্ষে বদলে যাবে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের দৃশ্যপট। শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলায় উৎসবমুখর হয়ে উঠবে নগরী। অনান্যবারের মতো ভোর সোয়া ছ’টায় রমনার বটমূলে ছায়ানটের শিল্পিদের ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ সুরে শুরু হবে বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা। বটমূল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, ধানমন্ডির লেকের পাড়, সংসদ ভবন চত্বর, শেরেবাংলা নগর, গুলশান, বনানী, উত্তরা, মিরপুর, যাত্রাবাড়িসহ রাজধানি ঢাকার নানাস্থানে পহেলা বৈশাখকে স্বাগত জানাতে চলছে অনুষ্ঠান। ভোর থেকে মহানগরীর পথে পথে আনন্দ পিয়াসী নগরবাসীর ঢল। সবার পরনে বৈশাখী রং লাল-সাদার পাশাপাশি নানা রংয়ের বাহারি নকশার পোশাক।
বাংলা ১৪২২ সালকে বিদায় এবং নববর্ষ ১৪২৩ বরণে অনুষ্ঠান চলছে তিন পার্বত্য জেলায়। আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ প্রতিবছরের মতো এবছরও বর্ণিল আয়োজনে পুরনো বর্ষকে বিদায় এবং নতুন বর্ষকে স্বাগত জানাচ্ছে।
নগরীর অভিজাত রেস্টুরেন্টগুলোতেও রয়েছে নববর্ষ উপলক্ষে খাবারের নানা আয়োজন। উচ্চ দামে ঘরে-বাইরে পান্তা-ইলিশের আয়োজনে রয়েছে কিছুটা ভাটা। ইলিশের অতি মূল্যের সংবাদে নববর্ষের আয়োজনে তা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । তবে রমনাসহ আশপাশের হোটেল-রেস্টুরেন্টে রয়েছে পান্তা-ইলিশের আয়োজন।
নববর্ষের এ আয়োজন বাংলাদেশে এখন আর সীমাবদ্ধ নেই। সার্বজনিন এ উৎসবে যুক্ত হয়েছে বিশ্বের দেশে থাকা বাঙালিরা।
নববর্ষ উপলক্ষে আজ সরকারি ছুটি। জাতীয় সংবাদপত্রগুলো বাংলা নববর্ষের বিশেষ দিক তুলে ধরে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। সরকারি ও বেসরকারি টিভি চ্যানেলে নববর্ষকে ঘিরে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালা প্রচারিত হচ্ছে।
বাঙালীর এই প্রাণের উৎসবকে ঘিরে রমনা পার্কসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পুরোটাই ঢেকে দেয়া হয়েছে নিরাপত্তা চাদরে। শুধু রাজধানী ঢাকাই নয় এ উপলক্ষে সারাদেশই নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ ও র্যা বের পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থা ও তাদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যৌথভাবে কাজ করছে সব সংস্থা।
সার্বিক নিরাপত্তা ও নজরদারি নিশ্চিত করতে বসানো হয়েছে কন্ট্রোল রুম, অবজারভেশন পোষ্ট ও চেকপোষ্ট। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি থাকছে গোয়েন্দা দলের সদস্য, বোমা ডিসপোজাল টিম ও মেডিক্যাল টিম।
বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শেষ করতে সময় বেধে দিয়েছে পুলিশ প্রশাসন। বলেছে উন্মুক্ত স্থানে অনুষ্ঠার শেষ করতে হবে বিকেল ৫টার আগে। এ নির্দেশনা নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন সংস্কৃতি কর্মিরা। তাদের মতে, সময় বেধে দিয়ে নববর্ষের আয়োজন ম্লান করা হয়েছে।
বাংলা সন প্রবর্তনের ইতিহাস
হিন্দু সৌর পঞ্জিকা মতে, বাংলা বার মাস অনেক আগে থেকেই পালিত হয়ে আসছিল। সৌর এ পঞ্জিকা শুরু হতো গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে উল্লিখিত এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে।
হিন্দু সৌর পঞ্জিকার আমলেও নববর্ষের উৎসব হত। তবে সে উৎসব ছিল ঋতুধর্মীয় উৎসব। মূলত তখনকার কৃষিকাজ-ভিত্তিক সমাজেই নিহিত ছিল এই উৎসবের তাৎপর্য। বঙ্গ, নেপাল, ত্রিপুরা, আসাম, উড়িষ্যা, কেরালা, মনিপুর, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ুর অধিবাসীরা এ উৎসব উদযাপন করত বেশ ঘটা করে। তবে নিজস্ব সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ হিসেবে এনব এলাকায় এ উৎসব উদযাপিত হত।
বাংলা সনের সঙ্গে হিজরি সন ও খ্রিস্টীয় বা গ্রেগরিয়ান সনের অনেক পার্থক্য আছে। যেমন, হিজরি সনের দিনগণনা শুরু হয় সন্ধ্যার নতুন চাঁদের আগমনের হিসাবে। অন্যদিকে, গ্রেগরিয়ান সনের দিনগণনা শুর হয় মধ্যরাতে ঘড়ির কাঁটা বারটা স্পর্শ করলে। আর বাংলা সনের দিন শুরু হয় সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে।
ভারতবর্ষের মোগল সম্রাটরা কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করতেন হিজরি পঞ্জিকার দিন-তারিখ অনুযায়ী। কিন্তু হিজরি সন আবার নির্ভর করে সম্পূর্ণ চাঁদের উপর। ফলে খাজনা আদায় করা নিয়ে বিপত্তি দেখা দেয় । সুষ্ঠুভাবে খাজনা আদায়ে নতুন পঞ্জিকা প্রবর্তন করেন মোগল সম্রাট আকবর । এই পঞ্জিকা সনই বাংলা সন হিসেবে পরিচিতি পায়।
সম্রাট আকবরের আদেশক্রমে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজী হিন্দু সৌর সন এবং আরবি হিজরি সনের ভিত্তিতে সম্পূর্ণ নতুন এই বাংলা সনের পঞ্জিকা তৈরি করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ (মতান্তরে ১১ মার্চ) থেকেই এই নতুন প্রবর্তিত সন গণনা শুরু হয়। তবে সম্রাট আকবরের সিংহাসন-আরোহণের বা অভিষেকের স্মরণে ধরা হয়, তার অভিষেক থেকেই এই বাংলা সন গণনা শুরু হয়েছে। অর্থাৎ, ৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬ ইংরেজি সন থেকেই। উল্লেখ্য, সর্বপ্রথম এই বাংলা সনের নামকরণ করা হয়েছিল ‘ফসলি সন’। পরে কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই ‘ফসলি সন’ই ‘বঙ্গাব্দ’ বা ‘বাংলা সন’ হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করে।
সম্রাট আকবরের সময় থেকেই ‘পহেলা বৈশাখ’ উদযাপন শুরু হয়। কিন্তু তখনকার পহেলা বৈশাখ উদযাপন এখনকার মতো ছিল না। তখনকার পহেলা বৈশাখ পালনে ভিন্নতা ছিল। যেমন, বছর শুরুর আগের দিনে, অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যেই সকলকে সকল প্রকার খাজনা-মাশুল-শুল্ক পরিশোধ করতে হত। আর পরের দিন, অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা, অর্থাৎ জমিদাররা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন।
. . . . . . . . .