সাম্প্রতিক হামলার সব বোমা তৈরি হয় ওখানেই!
সিলেটের কন্ঠ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ ডিসেম্বর ২০১৫, ২:২২ অপরাহ্ণরাজধানীর পুরান ঢাকায় হোসনী দালানে বোমা হামলা, আশুলিয়ায় ব্যাংক ডাকাতি, পুলিশ সদস্য হত্যা, বগুড়ার মসজিদে হামলা, রাজধানীর কামরাঙ্গীর চরে এবং চট্টগ্রামে বোমা উদ্ধারের ঘটনার তদন্তের বড় সূত্র খুঁজে পেয়েছে গোয়েন্দারা। এসব ঘটনায় বিশেষ ধরনের হ্যান্ডগ্রেনেড বোমা ব্যবহার বা জব্দ করা হয়েছে। তবে এসব বোমা কোথায়, কীভাবে তৈরি হয় এবং কীভাবে সরবরাহ করা হয়, এতোদিন তার রহস্য বের করতে পারেনি তদন্তকারীরা। বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিরপুরের শাহ আলীতে জেএমবির আস্তানায় অভিযানে মিলেছে সেই বিশেষ বোমার কারখানা।
ডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, হোসেনি দালানে হামলা এবং পুলিশ হত্যাসহ সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কয়েকটি ঘটনার বোমাগুলো তৈরি করা হয়েছে এই কারখানায়। কারিগরও ছিল একই। তবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিশেষ গ্রেনেডের কারিগরের নাম-পরিচয় প্রকাশ করেনি তদন্তকারীরা। হোসেনি দালান থেকে উদ্ধারকৃত বোমাগুলোতে ৪ লেখা ছিল। শাহ আলীতে উদ্ধারকৃত বোমাগুলোতে লেখা আছে ৫। সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, বোমা ও হামলার ক্রমিক নম্বর এগুলো।
বুধবার রাত ২টা থেকে বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টা পর্যন্ত শাহ আলীর এ ব্লকের ৯ নম্বর সড়কের ৩ নম্বর ভবনে অভিযান চালিয়ে ১৬টি হোমমেইড হ্যান্ডগ্রেনেড, দুইটি পাইপ বোমা, বোমা তৈরির সরঞ্জাম এবং প্রায় দুইশ বোমা তৈরির উপাদান জব্দ করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবির যুগ্ম-কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘গত চার মাস ধরেই বিস্ফোরক ও হামলার সঙ্গে জড়িত জেএমবির সদস্যদের ধরতে ব্যাপকভাবে অভিযান চালানো হচ্ছে। এ ধরনের বোমা উদ্ধার হয়েছে। বানানোর ব্যাপারে তথ্যও পাওয়া যায়। তবে কারিগর বা কারখানার সন্ধান মিলছিল না। এবার তা মিললো। গত চার মাসে বেশ কয়েকটি ঘটনায় ব্যবহৃত বোমা তৈরি করেছে এই চক্রটি। তারা এই আস্তানা ছাড়া আর কোথাও বোমা তৈরি করছে কি না, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’
মনিরুল ইসলাম আরো বলেন, ‘জেএমবির এই সদস্যরা সাম্প্রতিক ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া অন্যদের গ্রুপের। তারা সর্বশেষ আমির মাওলানা সাইদুর রহমানের অনুসারী নয়। তারা শিবিরের এক্স (সাবেক) ক্যাডার দিয়ে গঠিত জেএমবির একটি আলাদা দল, যারা উত্তরাঞ্চলে বেশি সক্রিয়। শুধু হোসনি দালান বা ঢাকার ঘটনাই নয় উত্তরাঞ্চলের ঘটনার সঙ্গে তাদের যোগসূত্র থাকতে পারে।’
ডিবির বোমা নিষ্ক্রিয়াকারী দলের প্রধান ও অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) ছানোয়ার হোসেন বাংলামেইলকে বলেন, ‘এগুলো আইইডি টাইপের বোমা, যেগুলো আগেও আমরা দেখিছি। কয়েকটি ঘটনায় এগুলো ব্যবহার হয়েছে। এগুলোকে হোমমেইড গ্রেনেডও বলে থাকে অনেকে। পাইপের মধ্যে বা শব্দ ধাতব বস্তুর মধ্যে সার্কিট বাসিয়ে তা তৈরি করা হয়।’
জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হোসেনি দালানে, পুলিশ হত্যা ও আশুলিয়ায় ব্যাংক ডাকাতির সময় একই ধরনের বোমা ব্যবহার করা হয়েছে। এখান থেকে বোমা সরবরাহ করার তথ্য পেয়েছি আমরা।’
এদিকে বোমা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ২৩ অক্টোবর রাতে রাজধানীর লালবাগে হোসনি দালানে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে বোমা হামলা চালিয়ে দুইজনকে হত্যা ও শতাধিক ব্যক্তিকে আহত করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় পাঁচটি বোমা ছোড়া হলেও দু’টি অবিস্ফোরিত উদ্ধার হয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গত ২৫ নভেম্বর পাঁচ জেএমবি সদস্যকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। গত ৪ নভেম্বর আশুলিয়ার বাড়ৈপাড়ায় পুলিশের চেকপোস্টে কনস্টেবল মুকুলকে হত্যা করে মোটরসাইকেল আরোহী দুই যুবক। গত ২১ এপ্রিল আশুলিয়ার কাঠগড়ায় বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে ডাকাতি ও আটজনকে হত্যার ঘটনাতেও জঙ্গিরা এই হোমমেইড গ্রেনেড ব্যবহার করে।
গত ফেব্রুয়ারি ও এপ্রিল মাসে চট্টগ্রাম থেকে হামজা ব্রিগেডের ২৪ সদস্যকে গ্রেপ্তারের সময়ও এই গ্রেনেড উদ্ধার করে র্যাব। গত ১৯ অক্টোবর রাজধানীর গাবতলীতে পুলিশের চেকপোস্টে এএসআই ইব্রাহিম মোল্লাকে কুপিয়ে হত্যা পর কামরাঙ্গীর চরের একটি বাসা থেকে একই রকম পাঁচটি হ্যান্ডগ্রেনেড উদ্ধার করা হয়। গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশালে ফিল্মি স্টাইলে জেএমবির দুর্ধর্ষ তিন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয় সহযোগীরা। ওই ঘটনায় জঙ্গিরা সাম্প্রতিক হামলায় ব্যবহৃত বিশেষ হ্যান্ডগ্রেনেড ব্যবহার করে বলে জানা গেছে।
এছাড়া সম্প্রতি দিনাজপুরের কান্তজিউর মন্দির ও ইসকন মন্দিরে হামলাসহ বিভিন্ন ঘটনায় একই ধরনের বোমা ব্যবহার করা হয়। এই বোমাগুলো দেশীয়ভাবে তৈরি ও সরবরাহের তথ্য পাওয়া গেলেও কারিগরদের সন্ধান পাচ্ছিল না গোয়েন্দারা।
ডিবির উপ-কমিশনার (ডিসি) মাশরুকুর রহমান খালেদ বাংলামেইলকে বলেন, ‘এখান থেকে উদ্ধার করা বোমাগুলোর গায়ে ৫ নম্বর লেখা আছে। হোসেনি দালানের বোমাগুলোতে লেখা ছিল ৪। এতে ধারণা করা হচ্ছে- বোমা বা হামলার ক্রমিক নম্বর ব্যবহার করছে একই চক্র।’
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে এক ডিবি কর্মকর্তা জানান, হোসেনি দালানের ঘটনায় আটক বগুড়ার এক ব্যক্তিই শাহ আলীর বোমা কারখানাটির তথ্য দেয়। চারমাস আগে নজরুল নামের একজন চাকরিজীবী এবং তার সঙ্গে ছাত্ররা থাকবেন বলে দুই কক্ষের বাসাটি ভাড়া নেন। দুই কক্ষের একটিতে উদ্ধারকৃত ১৮টি বোমা মজুদ করে রাখা ছিল। সেখানেই মূলত বোমা তৈরি করা হয়। বোমা তৈরির জন্য লোহার পাইপ কাটার যন্ত্র (লেদ যন্ত্র) ছিল সেখানে। ছিল স্প্লিন্টার।
আস্তানাটি যারা চালাতেন তাদের মধ্যে একজন জেএমবি নেতা সাজিদের অনুসারী। একজনের বাড়ি চট্টগ্রামে। বাকিদের গ্রামের বাড়ি উত্তরাঞ্চলে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাসায় যারা বসবাস করত এবং যারা তাদের কাছে আসত তারা জেএমবির জামায়াতপন্থি। এই দলটি অপারেশনাল কাজে অংশ নেয় না। তারা মূলত বিশেষ হ্যান্ড গ্রেনেডগুলো তৈরি এবং সরবরাহ করে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, মিরপুরের ১ নম্বর সেকশনের এ ব্লকের ৯ নম্বর রোডের এই বাসাটি ভাড়া নেয়ার আগে চক্রটি তুরাগ এলাকায় অবস্থান করছিল। ওই এলাকা থেকে তাদের কয়েকজন সহযোগী সম্প্রতি ধরা পড়ে। এরপর বাকিরা অবস্থান পরিবর্তন করে।
এডিসি ছানোয়ার হোসেন বলেন, ‘বোমার উপাদান ও ধ্বংসাবশেষগুলো পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। তারা এম্যাচার স্টাইলেই বোমা তৈরি করছিল। আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি বোমাগুলো পরীক্ষা করে তারা কীভাবে এগুলো তৈরি করেছে তার বিস্তারিত জানার চেষ্টা করা হবে।’
বাংলামেইল২৪ডটকম
. . . . . . . . .