হঠাৎ অস্থিরতা চারদিকে
সিলেটের কন্ঠ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ অক্টোবর ২০১৫, ১১:৩২ অপরাহ্ণসেপ্টেম্বরের ২৮ তারিখে রাজধানীর কূটনৈতিক পল্লী গুলশানে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের গুলিতে নিহত হন ইতালির নাগরিক তাভেলা সিজার। এর পাঁচ দিনের মাথায় রংপুরে একই কায়দায় খুন করা হয় জাপানি নাগরিক হোশি কোনিওকে। বিদেশি হত্যার পৃথক দুই ঘটনার পর তৎপর হয়ে ওঠে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সারা দেশে বিশেষ করে রাজধানীতে জোরদার করা হয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। এসব ঘটনার পর এক মাস পার না হতেই রাজধানীর গাবতলী এলাকায় চেকপোস্টে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় পুলিশের এক কর্মকর্তাকে। পবিত্র আশুরা উপলক্ষে শুক্রবার মধ্যরাতে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যেও পুরান ঢাকার হোসনি দালান এলাকায় বোমা হামলায় মারা যায় এক কিশোর। আহত হন অর্ধশতাধিক ব্যক্তি। এ যেন হঠাৎ অস্থিরতা চারদিকে। বর্তমানে রাজপথে বিরোধী দলকে মোকাবিলা করতে না হলেও এসব অপ্রত্যাশিত ঘটনায় অস্বস্তি বাড়ছে সরকারের ভিতরে। আলোচিত তিনটি হত্যাকাণ্ড এবং শিয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনা যে পরিকল্পিত তা সরকার নিশ্চিত। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ও নাশকতার পেছনে কারা জড়িত এবং কেন একের পর এক এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে তা নিয়ে চলছে সরকার, গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর বিচার-বিশ্লেষণ। ইতিমধ্যে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এসব ঘটনাকে সরকার ও দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিগুলোকে দায়ী করছেন। তাদের অনেকেই মনে করেন, যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায় কার্যকরে বাধা সৃষ্টি করতেই সুপরিকল্পিতভাবে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলী একই সূত্রে গাথা বলে দাবি করেছেন সরকারের মন্ত্রী ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। ইতালির নাগরিক তাভেলা সিজার ও জাপানি নাগরিক হোশি কোনিওর হত্যাকাণ্ডের পর রাজধানীসহ সারা দেশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাসও দেওয়া হয়। কিন্তু যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ গুরুত্বপূর্ণ দূতাবাসগুলোর পক্ষ থেকে তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণে বারবার সতর্কতা জারি করা হচ্ছে। আবার বিদেশিদের ওপর হামলারও আশঙ্কা করছেন তারা। অন্যদিকে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে কর্মরত বিদেশি নাগরিকরা বাংলাদেশ ছেড়ে যাচ্ছেন। যদিও ইতিমধ্যে সরকার ও পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা বিদেশি নাগরিক হত্যায় জড়িতদের শনাক্ত করতে পেরেছেন এবং সারা দেশে ব্যাপক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে সারা দেশ, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা যখন কঠোর নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা ঠিক তখন ২২ অক্টোবর রাজধানীর গাবতলী এলাকায় পুলিশের চেকপোস্টে সংঘবদ্ধ দুষ্কৃতকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন দারুস সালাম থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) ইব্রাহিম মোল্লা (৪০)। এ ঘটনার একদিন পর শুক্রবার মধ্যরাতে আশুরার তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির সময় পুরান ঢাকার হোসনি দালান ইমামবাড়ায় উপর্যুপরি বোমা হামলায় সাজ্জাদ হোসেন সাজু নামে এক কিশোর নিহত হয়। এসব ঘটনার বাইরে ২ অক্টোবর গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ আসনের সরকারদলীয় এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন মাতাল অবস্থায় গাড়িতে বসে নিজের পিস্তল থেকে শিশু সৌরভকে গুলি ছোড়েন। সৌরভের দুই পা গুলিবিদ্ধ হয়। এ ঘটনায় সুন্দরগঞ্জের মানুষ এমপির বিচারের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে। সরকার এমপি লিটনের পিস্তলের লাইসেন্স বাতিল করে। সুন্দরগঞ্জ থানায় মামলা হয়। অবশেষে পুলিশ রাজধানীর উত্তরায় অভিযান চালিয়ে পলাতক এমপি লিটনকে গ্রেফতার করে। তার আগে আদালত এমপির জামিন আবেদন নাকচ করে দেন। সরকার ও আওয়ামী লীগের একাধিক নীতিনির্ধারক জানিয়েছেন, রাজপথে যখন বিরোধী দলকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে না, সরকার যখন সব দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে তখন একটি বিশেষ মহল সরকারের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করতেই তৎপর হয়ে উঠেছে। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিই সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এবং দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতেই এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে বলে দাবি করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। বিশেষ করে দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত করতেই পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। এ ছাড়াও বাংলাদেশে যে কোনো ঘটনা ঘটলেই আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের দায় স্বীকারও নতুন করে বিব্রত করছে সরকারকে। এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, বাংলাদেশে সাংগঠনিকভাবে আইএসের অস্তিত্ব থাকার কোনো প্রমাণ গোয়েন্দারা পাননি। একটা কিছু হলেই তাৎক্ষণিক আইএস বিবৃতি দিচ্ছে। এসব সরকার বিরোধীদের প্রপাগান্ডা হতে পারে এবং তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। তিনি বলেন, আমরা এসব ঘটনার তদন্ত করছি। যারাই হরকাতুল জিহাদ, তারাই হুজি, তারাই জেএমবি, তারাই আনসারুল্লাহ, শিবির। সবই একসূত্রে গাথা। তিনি বলেন, আমরা ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছি। এখানে অন্য কোনো টেরোরিস্ট থাকতে পারে। তদন্ত করছি, শেষ হলে স্পষ্ট করে প্রকাশ করব। কে কার সঙ্গে জড়িত তা খুব শিগগিরই জানাব। আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সঙ্গে বিভিন্ন শক্তির যোগসূত্র আছে। আগে দেখতে হবে প্রথম কারা নিরাপত্তা সতর্কতা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রই প্রথম অ্যালার্ট দিয়েছে। আমি দেশটির সরকারকে বলব, সব সময় সব রকম সন্ত্রাসকে, দেশকে যেভাবে দেখেন বাংলাদেশকে সেভাবে দেখবেন না। দেখলে ভালো করে তদন্ত করে দেখুন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও ১৪ দলের সমন্বয়ক মোহাম্মদ নাসিম বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন শান্তির দ্বীপ হিসেবে এগিয়ে যাচ্ছে। ঠিক তখনই দুই বিদেশিকে হত্যা করা হলো। পুলিশের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। তিনি বলেন, একজন নেতা বা নেত্রী বিদেশে বসে হয়তো দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছেন। যে সাহসী সে সামনে এসে লড়াই করে। বিদেশে বসে যে লড়াই করে, চক্রান্ত করে, সে কাপুরুষ। লড়াই করতে চাইলে সামনে আসেন। বিদেশে বসে ষড়যন্ত্র করবেন না। দলীয় সূত্র মতে, গত শনিবার আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক বৈঠকে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো সরকার ও দলের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে নেতা-কর্মীদের সতর্ক থাকতে নির্দেশনা দেন সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যরা।
বৈঠকে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, সরকারকে বিব্রত করার জন্য বিদেশিসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। যারা আন্দোলনের নামে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করেছিল, তারাই দেশের পাশাপাশি বিদেশি নাগরিক হত্যা করছে। এটা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। বৈঠকে একাধিক সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য বলেছেন, আমাদের বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে লাভ হবে না। প্রকৃত রহস্য উন্মোচন করে জাতিকে জানাতে হবে। এসব ঘটনা দলের জন্য চরম বিব্রতকর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের এক প্রেসিডিয়াম সদস্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে এবং এ বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আন্দোলনের নামে দেশে অস্থিরতা ও সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। এখন তাদের সেই সাংগঠনিক শক্তি নেই। সরকার অনেকটা নির্বিঘ্নে দেশ চালাচ্ছে। এরই মধ্যে বিদেশি নাগরিক, পুলিশ হত্যার মাধ্যমে দেশি-বিদেশি চক্র নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। এ ছাড়াও একের পর এক এসব ঘটনা যেন হঠাৎ অস্থিরতা বাড়িয়ে দিয়েছে।
. . . . . . . . .