যে কারণে জামায়াত ছাড়ছে পারে বিএনপি!
সিলেটের কন্ঠ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ অক্টোবর ২০১৫, ১০:০৬ অপরাহ্ণজামায়াত ইস্যুতে অনেক খেসারত দিতে হয়েছে বিএনপিকে। আবার বিগত সময়ে আন্দোলন-সংগ্রামে জামায়াত বিএনপি নেতাকর্মীদের চেয়ে মাঠে বড় ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু জামায়াত ইস্যুতে বিএনপিকে বরাবরই কাবু করেছে আওয়ামী লীগ। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়লাভ করে। আর তখন থেকেই জামায়াত ইস্যুতে বিএনপিকে ঘায়েল করে ফেলেছে আওয়ামী লীগ। ভারতসহ পশ্চিমা দেশগুলো জামায়াতকে ভালো চোখে দেখে না। সে কারণে জামায়াতের সঙ্গে পাকাপোক্তভাবে জোট বাঁধায় বিএনপিকে সমর্থন করছে না দেশগুলো। তাই ভারতের সমর্থন পেতে জামায়াতকে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে দলটি। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পর এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
জানা যায়, ভারত-পাকিস্তান কেউ কাউকে বন্ধু মনে করে না। ভারত পররাষ্ট্রনীতিতে পাকিস্তানকে তাদের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য ভারত অগ্রণী ভূমিকা রাখে। আর তখন কিছু বাঙালি পাকিস্তানের পক্ষ নেয়। পাকিস্তানের হয়ে নিরীহ বাঙালিদের অত্যাচার-নির্যাতন চালায়। তখন ছিল তারা রাজাকার। সেই রাজাকারদের অনেকেই জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা হিসেবে পরিচিতি পান। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় গিয়ে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে জামায়াতের সেই শীর্ষ নেতাদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করায়। যে কারণে আওয়ামী লীগ দেশবাসীসহ ভারত ও পশ্চিমা দেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ভারতের সাবেক কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তবে বর্তমান বিজেপি সরকারের সঙ্গেও আওয়ামী লীগের সম্পর্ক বেশ ভালো।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘বর্তমানে ভারতে যে দল ক্ষমতাসীন আছে তারা আগের ক্ষমতাসীন দলের মতো নয়। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার বিনা স্বার্থে আওয়ামী লীগ সরকারকে যেভাবে সাপোর্ট দিত, বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার সেভাবে আওয়ামী লীগ সরকারকে সাপোর্ট দিচ্ছে না। মনে হয় দেবেও না। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের যে সম্পর্ক ছিল, বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে সেই সম্পর্ক নেই।’
সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ভারতের সমর্থনের কারণে পশ্চিমা কয়েকটি দেশের চাপ থাকা সত্ত্বেও সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। ওই নির্বাচনের আগে থেকেই সব দলের অংশগ্রহণে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে আসছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। এমনকি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ওই দেশগুলো পর্যবেক্ষকও পাঠায়নি। এতকিছুর পর বর্তমান বাস্তবতায় বিএনপি বুঝতে পেরেছে, তাদের ক্ষমতায় যেতে হলে ভারতের সমর্থন দরকার। তাই এখন ভারতকে খুশি করতে সব সুবিধা দিতে প্রস্তুত বিএনপি। তবে জামায়াতকে ছাড়তে সরাসরি কোনো কিছুই বলছে না ভারত। কিন্তু জামায়াতকে ছাড়লে বিএনপির ওপর ভারত খুশি হয় এমন ইঙ্গিত তারা দিচ্ছে। আর এ কারণেই আপাতত জামায়াত ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে দলটি।
বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি ভারতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে- এমন বিষয়কে আলোচনার সামনে রেখে মধ্যবর্তী নির্বাচন আদায়ের লক্ষ্যে বিএনপি ভারতের সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে অনেক আগে থেকেই তারেক রহমানের সখ্য রয়েছে। তাই বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতা ভারত সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা চালাচ্ছেন বলে বিএনপির একাধিক সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে দেশে আসার পর সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে জামায়াত ছাড়ার ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন বলে জানা গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতি বা সরকার গঠনে ভারতের প্রভাব খুবই বেশি।’ বিএনপি জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে পারে কি-না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির যে ‘অ্যালায়েন্স’ অর্থাৎ ‘ফোর পার্ট’, এখন তো ২০ দলীয় জোট; আগে ছিল চারদলীয় জোট। চারদলীয় জোট থাকার অর্থ এই যে, ‘আইডিওলজি’ এক নয়। ভিন্ন ভিন্ন ‘আইডিওলজি’। একেকটি পার্টির আদর্শ অন্যরকম। ইলেকশনের জন্য, ইলেকশনে সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য তারা একটি প্লাটফর্মে এসেছে। সুতরাং এক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া তো কোনো ব্যাপার নয়। যে কোনো মুহূর্তে এটা ভেঙেও দেওয়া যায়।’
শোনা যাচ্ছে, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি থাকুক এটা ভারত চাচ্ছে না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওরকমভাবে ঠিক কিছু বলে না। তবে তারা খুশি হবে- এরকম একটা আভাস মেলে।’
বিএনপিকে সমর্থন দেওয়ার ব্যাপারে আলোচনায় ভারত কোন বিষয় গুরুত্ব দিচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাবির এই সাবেক উপাচার্য বলেন, ‘জামায়াতের বিষয়ে তারা বেশি গুরুত্ব দেয় না। তারা গুরুত্ব দিচ্ছে দুটি বিষয়ে। তারা দুটি বিষয়ে সুবিধা চায়। এক হলো, উত্তর-পূর্ব ভারতে কোনো লোক, যারা রাষ্ট্রদ্রোহী- ভারতবিরোধী কাজে লিপ্ত, তাদের যেন বাংলাদেশ আশ্রয় না দেয়। দ্বিতীয় হলো, বিভিন্ন রুটে করিডোর অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্যিক সুবিধা।’
জামায়াতকে নিয়েও বিএনপির অনেকের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। অনেকেই জামায়াতকে খুব একটা পছন্দ করেন না। প্রকাশ্যে কেউ কিছু না বললেও ভেতরে ভেতরে অনেকেই জামায়াতের সমালোচনা করেন। লন্ডনে বসে একটি সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা বলেছেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সখ্য খুব একটা ভালো লাগে না। তারপরও বলতে হয়, দুই দলের ঐক্যটা কৌশলগত। বিএনপি ও জামায়াতের আদর্শ ভিন্ন। দুই দলই ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে রাজনীতি করছে।’ সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেছেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে শুধু বিএনপির নয়, আওয়ামী লীগেরও মিতালী ছিল।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কখনো খারাপ ছিল না। এখনও ভালো সম্পর্ক। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দেশে ফেরার পর জামায়াত ছাড়ার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন কি-না তা তাঁর জানা নেই।’
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন বিএনপির জন্য অত্যন্ত জরুরি। ভৌগোলিকভাবে ভারতের অবস্থান এমন এক জায়গায় যাকে বাংলাদেশ কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারে না। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধে দেশটির ভূমিকা, সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশে তার চাওয়া-পাওয়ার মূল্য আছে। তবে সবকিছু সমতার ভিত্তিতে হওয়াই বাঞ্ছনীয়।’
দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘জামায়াতকে জোটে রাখা নিয়ে নানা ধরনের কথা চালু থাকলেও দলীয় ফোরামে আলোচনা ছাড়া এ বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না।’
অপরদিকে জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য হামিদুর রহমান আযাদ সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের কোনো দূরত্ব নেই। লন্ডনে যাওয়ার আগেও জোটনেত্রী তাঁদের সঙ্গে বৈঠক করে গেছেন। জামায়াত প্রশ্নে ভারত বা বাইরের কোনো দেশের চাপের বিষয়টি আমাদের জানা নেই।
. . . . . . . . .