এএসপিকে থানার ‘ওসি’ করার উদ্যোগে পুলিশে চাপা ক্ষোভ
সিলেটের কন্ঠ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১১:০৭ পূর্বাহ্ণ
পুলিশ বাহিনীতে এসআই ও পরিদর্শক পদে বেতন গ্রেড নিয়ে ক্ষোভের রেশ এখনো কাটেনি। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ১৮টি থানাসহ দেশের ৭৭টি থানার প্রধান হিসেবে সহকারি পুলিশ সুপার (এএসপি) পদবীর কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে সরকার। এই নিয়ে মাঠপর্যায়ে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
বাংলাদেশ পুলিশে তিন ক্যাটাগরিতে নিয়োগ দেয়া হয়। কনস্টেবল, উপ-পরিদর্শক ও সহকারী পুলিশ সুপার।
পদোন্নতি পেয়ে একজন কনস্টেবল এসআই পর্যন্ত হন। উপ-পরিদর্শকরা পদোন্নতি পেয়ে ন্যুনতম পরিদর্শক হন; কেউ কেউ সহকারী পুলিশ সুপার পর্যন্ত যেতে পারেন। আর সহকারী পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেতে পেতে একপর্যায়ে পুলিশ প্রধান পর্যন্ত হতে পারেন। তবে তাদের অনেকেই পুলিশ সুপার পর্যন্ত হয়ে যান।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, উপ-পরিদর্শক (এসআই) পদে পুলিশে প্রবেশ করা কর্মকর্তারা স্বপ্ন দেখেন একদিন পরিদর্শক হবেন; থানার ওসির দায়িত্ব নেবেন। সে পরিকল্পনা অনুযায়ী ভালো কাজ করে, নিজেকে বিতর্কমুক্ত রেখে পদোন্নতি নেওয়ার চেষ্টায় থাকেন তারা। যার সুফল পায় সাধারণ সেবা প্রত্যাশী মানুষ। কিন্তু এখন একজন এসআই যখন দেখবেন, ভালো কাজ করলেও থানার প্রধান হওয়া যাবে না; তখন ভালো কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন ওই এসআই।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশে কর্মরত একজন পরিদর্শক বলেন, পুলিশ পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পেতে এসআই হিসেবে দীর্ঘ ৫-৭ বছর কাজ করতে হয়। এই সময়ে অপরাধ জগত নিয়ে কাজ করে যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়। এরপর আরো দুই-চার বছর পর জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে থানার ওসি হিসেবে দায়িত্ব পান। স্বাভাবিকভাবেই ওসি পদের কর্মকর্তারা যে মাপের দক্ষতা ও যোগ্যতার অধিকারী হয়; তার ধারে কাছেও পৌঁছতে পারেন না সদ্য নিয়োগ পাওয়া সহকারী পুলিশ সুপার পদের বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তারা।
পুলিশ সদর দফতর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি অংশ মনে করেন, এএসপি পদমর্যাদার কর্মকর্তাদেরকে থানার প্রধান কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হলে পুলিশের সেবা ও তদন্ত মান বাড়বে। এতে পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি উজ্জল হবে। এরই অংশ হিসেবে এর আগেও অন্তত তিনবার থানায় এএসপি পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ নেয় মন্ত্রণালয়। কিন্তু মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের অসন্তোষের কারণে সে উদ্যোগ বাস্তবায়ন থেকে সরে আসেন সংশ্লিষ্টরা।
এমনকি দেশের কিছু কিছু থানাকে ‘মডেল থানা’ ঘোষণা দিয়ে সেগুলোতে এএসপি পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, এ উদ্যোগেরও সুফল পাওয়া যায়নি; দেশের মডেল থানাগুলো জনমানুষের প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হয়নি। এসব থানাগুলো নামেই মডেল- বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশে কর্মরত এক পুলিশ পরিদর্শক বলেন, থানার ওসিরা চাইলেই দুর্নীতি না করে চলতে পারবেন; তাদের সে সুযোগ রয়েছে। কারণ ওসি পদের ওই কর্মকর্তা দীর্ঘকাল এসআই ছিলেন; শান্তিরক্ষা মিশনে গেছেন; এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই তিনি আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হবেন। কিন্তু এএসপি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বিসিএস-পুলিশ ক্যাডার পেয়ে চাকরিতে মাত্রই প্রবেশ করেন। ফলে টাকার প্রতি তার লোভ থাকবেই; আর সেটা একেবারেই স্বাভাবিক। তাই থানার দায়িত্ব পেলে এএসপি পদের কর্মকর্তারা অন্যায়-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়বেন- এমন সম্ভাবনাই বেশী।
অন্য এক পুলিশ পরিদর্শক বলেন, পুলিশিং নিয়ে পুথিগত জ্ঞান অর্জন করে চাকরিতে জয়েন করেন এএসপিরা; তাদের অপরাধ জগতের বাস্তব অভিজ্ঞতাই নেই। আর অন্যদিকে মাঠ-ঘাটের নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে, দক্ষতা দেখিয়ে এসআই থেকে পদোন্নতি পেয়ে একজন কর্মকর্তা থানার ওসি হন। তাই থানার দায়িত্ব সামলানোটা পুলিশ পরিদর্শকরা যেভাবে পারবেন; এএসপি’দের জন্য সেভাবে সম্ভব হয়ে উঠবে না। তাছাড়া দৈনন্দিন কার্যক্রমে পরিদর্শক ও উপ-পরিদর্শকরা যদি এএসপি পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে অসহযোগিতা করেন, তাহলে থানার কার্যক্রম অচল হয়ে পড়বে।
চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন এসআই বলেন, এমনিতে পদ সমন্বয় নিয়ে পুলিশে ক্ষোভ আছে। থানায় এএসপি নিয়োগের এই সিদ্ধান্ত সরকার নিয়ে থাকলে, সেটা খারাপ সিদ্ধান্ত হবে। এ সিদ্ধান্তটা আগামীতে পুলিশ বাহিনীর ভেতরে বড় সমস্যা তৈরী করবে।
চট্টগ্রামের একটি থানার ওসি বলেন, আমাদের দেশে বিট্রিশদের নানা আইনকানুন মানা হয়। কিন্তু ব্রিটিশ পুলিশ যে নিয়মকানুন মেনে চলে, তা মানা হয়না কেন? ব্রিটিশ পুলিশে যোগ দেওয়ার সময় সবাই কনস্টেবল হিসেবে যোগ দেয়। এরপর যোগ্যতা অনুযায়ী পদোন্নতি পেয়ে বড় দায়িত্ব পায়। আমাদের দেশে সে রকম সিস্টেম থাকলে, অসন্তোষের সৃষ্টি হত না। এখন বয়সে অনেক জুনিয়র একজন এসে সুপারভাইজ করে। তিনি এ পেশায় নতুন মানুষ, আইন-অপরাধের কিছু ভালোভাবে বুঝেন না, তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আমাদের সুপারভাইজিং করতে! উল্টো, এএসপি পদমর্যাদার এসব কর্মকর্তাদের নানান খুঁটিনাটি বিষয় শিখিয়ে দিতে হয় আমাদেরকে।
তিনি বলেন, এএসপি’রা শিক্ষায় হয়ত এগিয়ে থাকবেন। তবে দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও কর্মোদ্যমে ওসিরাই এগিয়ে থাকবেন। অপরাধ দমন-নিয়ন্ত্রণের প্রায় সব কাজই করেন পরিদর্শক ও এসআইরা; কিন্তু সাফল্যের ভাগ নেন এএসপি’রা। তৃণমূল পর্যায়ে পুলিশের সেবা দেওয়ার জন্য থানার প্রধান হিসেবে পরিদর্শকরা ভালো করবেন।
দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ক্যাডার পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে ডিপার্টমেন্টাল পুলিশ ও বিসিএস ক্যাডার পুলিশের সংখ্যা পুলিশে অর্ধেক-অর্ধেক হবে। কিন্তু সেটা হয়নি; এএসপি পদ পূরণে ৩০ ভাগ ডিপার্টমেন্টাল পুলিশ (ওসি থেকে এএসপি হওয়া কর্মকর্তা) ও ৭০ ভাগ বিসিএস ক্যাডার অফিসার নেয়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশে কর্মরত এক সহকারি কমিশনার বলেন, পরিদর্শক থেকে পদোন্নতি পাওয়া এএসপি ও জ্যেষ্ঠ এএসপি’দেরকে থানার প্রধান করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। কর্মক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার কারণে এসব কর্মকর্তা অবশ্যই ভালো করবেন। এতে পুলিশের সেবা আরো ভালো হবে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার ইকবাল বাহার বলেন, থানার প্রধান হিসেবে এএসপিদেরকে কখন-কিভাবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে- এসব বিষয় আমার জানা নেই। তবে প্রত্যেক কাজেরই পক্ষে-বিপক্ষে থাকে। যেটা যুক্তিযুক্ত সেটাই শেষ পর্যন্ত করা হয়।
. . . . . . . . .