এম সি কলেজ সিলেট: একটি নাম একটি ইতিহাস
সিলেটের কন্ঠ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫, ১০:৪৪ পূর্বাহ্ণরায়নগরের জমিদার রাজা গিরীশ চন্দ্র রায় তাঁর মাতামহ মুরারী চাঁদ রায়ের স্মৃতি রক্ষার্থে ১৮৮৬ সালের ১৭ জুন প্রতিষ্ঠা করেন মুরারী চাঁদ হাই স্কুল। ১৮৯১ সালে এই স্কুলেই উচ্চ মাধ্যমিক অর্থাৎ তৎকালীন এফ.এ ক্লাশ খোলার অনুমতি দেয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৮৯২ সালের ২৭ জুন দ্বিতীয় গ্রেড লাভকারী আসাম প্রদেশের একমাত্র কলেজ হিসেবে মুরারী চাঁদ কলেজের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। ১৮৯৩ সালে মুরারী চাঁদ কলেজ থেকে এফ.এ পরীক্ষায় প্রথম ব্যাচ ছাত্র অংশগ্রহণ করে। সেসময় ছাত্রদের বেতন ছিল ৪ টাকা এবং ১ম বিভাগে এন্ট্রান্স পাশকৃতদের জন্য বিনা খরচে পড়ার ব্যবস্থা ছিল।
১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে জমিদারবাড়িসহ কলেজ ভবনটি ধ্বংস হয়ে গেলে রাজা গিরীশ চন্দ্র কলেজটি পুনঃনির্মাণ করেন।১৮৯২ সাল থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত রাজা গিরিশচন্দ্র রায় নিজেই কলেজটির সকল খরচ বহন করেন। ১৯০৮ সালে রাজা মারা গেলে কলেজটি সরকারী সহায়তা চায় এবং সরকার মুরারী চাঁদ কলেজকে মাসিক ৫০০ টাকা গ্র্যান্ট-ইন-এইড্ মঞ্জুরি প্রদান করেন। ১৯১২ সালের ১ এপ্রিল ৯৮ জন ছাত্র ও ৬ জন শিক্ষক নিয়ে কলেজটি পূর্ণাঙ্গ সরকারি কলেজ রুপে আত্মপ্রকাশ করে। পূর্বের মুরারিচাঁদ স্কুলের পাশে গোবিন্দ পার্কে (বর্তমান হাসান মার্কেট) কলেজের জন্য আলাদা ভবন (চং বাংলো) নির্মিত হয়।একই বছর তৎকালীন আসামের চিফ কমিশনার স্যার আর্চডেল আর্ল কলেজটিকে ২য় শ্রেণীর কলেজ থেকে ১ম শ্রেণীর কলেজে উন্নীত করেন । ১৯১৩ সালে কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক বিজ্ঞান ক্লাস চালু হয়।পরবর্তীতে জননেতা আব্দুল মজিদ (কাপ্তান মিয়া) সহ আরো অনেকে মিলে ১৮০০০ টাকা অনুদান দিলে কলেজটিতে স্নাতক শ্রেণীর কার্যক্রম চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়। ১৯১৬ সালে কলেজে বি.এ ক্লাশ চালু হয় এবং ১৯১৭ সালে বি.এ পরীক্ষায় প্রথম ব্যাচের ছাত্ররা অংশগ্রহণ করে। ১৯১৮ সালে এ কলেজে প্রথম সংস্কৃত বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু হয়।১ম বিশ্বযুদ্ধ ও অন্যান্য নানা সমস্যার কারনে কলেজের ক্যাম্পাস পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দেয়।তখন সিলেটের কৃতি সন্তান খান বাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদ (কাপ্তান মিয়া)- আসামের শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন আসামের গভর্নর স্যার উইলিয়াম মরিসকে সথে নিয়ে থ্যাকারে টিলায় মুরারী চাঁদ কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কলেজ থেকে ৩ কি. মি. দুরে থ্যাকারে টিলায় (বর্তমান টিলাগড়) ১২৪ একর ভুমি নিয়ে বিশাল ক্যাম্পাসে কলেজের ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হলে ১৯২৫ সালেই উদ্বোধন করেন তৎকালীন আসামের গভর্ণর স্যার উইলিয়াম রীড। এখনো নাম ফলকটি পাতরে খোদাই করা আছে।উল্যেখ্য খান বাহাদুর আব্দুল মজিদ আসামের শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন এম সি কলেজকে নিয়ে সিলেটের শিক্ষা উন্নয়নে একটি মাস্টার প্ল্যান করা হয়। কিন্তু সিলেটবাসীর দুর্ভাগ্য যে শিক্ষা উন্নয়নের এই মহান পুরুষ মাত্র দুই বছর শিক্ষামন্ত্রীর দায়ীত্ত পালনকালে পঞ্চাশ বছর বয়সে মৃত্যবরন করায় রাজা গিরিসচন্দ্রের পর এমসি কলেজ হারায় তার দ্বিতীয় অভিভাবক। এর পর ১৯৪৭ এর আগ পর্যন্ত আসাম প্রদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিট হিসেবে কলেজটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল। দেশ বিভাগের পর এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আসে। ১৯৬৮ সালে কলেজটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়।
ষাটের দশকের শুরুতে শরীফ কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে কলেজের উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক শাখা পৃথক করার পরিকল্পনা গৃহীত হয়। তদনুযায়ী কলেজের পূর্ব পাশে ১৯৬৬ সালের জুলাই থেকে সিলেটে একটি স্বতন্ত্র উচ্চমাধ্যমিক সরকারি কলেজ চালু করা হয়। নবপ্রতিষ্ঠিত কলেজটিকে মুরারী চাঁদ উচ্চমাধ্যমিক কলেজ এবং পুরাতন মুরারী চাঁদ কলেজকে সিলেট সরকারি কলেজ নামকরণ করা হয়। এর পেছনে যুক্তি ছিল, রাজা গিরীশচন্দ্র কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মুরারী চাঁদ কলেজটি ছিল উচ্চমাধ্যমিক কলেজ এবং সেটি সরকারি ব্যয়ে ডিগ্রি পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল। ১৯৯৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর তদানীন্তন শিক্ষা সচিব হেদায়েত আহমদের উদ্যোগে কলেজের পূর্বনাম মুরারী চাঁদ কলেজ বহাল রাখা হয় এবং নতুন কলেজটিকে ডিগ্রি পর্যায়ে উন্নীত করে সিলেট সরকারি কলেজ নামকরণ করা হয়।
বর্তমানে মুরারী চাঁদ কলেজে উচ্চমাধ্যমিক বিজ্ঞান শাখাসহ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তিনটি অনুষদে মোট সতেরটি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) এবং স্নাতকোত্তর কোর্স চালু রয়েছে। অধ্যক্ষসহ কলেজে মোট শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা ১৫৩। বর্তমানে এর ছাত্রছাত্রী সংখ্যা প্রায় পোনের হাজার। কলেজে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার আছে। ২০০০ সালে কলেজটি দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
দেশ ও জাতীর প্রতিটি ক্রান্তিকাল এবং রাজনৈতিক উত্তান পথনে বৃটিশ আমল থেকে আজকের বাংলাদেশের সৃষ্টিলগ্ন পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রেই ভুমিকা রেখে আসছে এই বিদ্যাপীঠ ও তার কৃতিছাত্ররা। সমগ্র ভারতব্যাপী বৃটিশ খেদাও অন্দোলন শুরুহলে সমগ্র আসাম প্রদেশে যারা ছাত্র আন্দোলনকে বেগবান করেন তাদের অনেকেই ছিলেন এইকলেজের ছাত্র। মুসলিমপ্রধান এই অঞ্চলে ছাত্রদের প্রতিনিত্তকারী মুসলিম ছাত্রফেডারেশের সভাপতিত্বকারী আবদুস সামাদ আজাদ এমসি কলেজের তৎকালীন ছাত্র ছিলেন। যিনি পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দোলন নেতৃত্বদানকারীদের অন্যতম এবং বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও সফল কুটনীতিকের মর্জাদা লাভ করেন।
বৃটিশ ভারত থেকে পাকিস্তান সৃষ্টি আন্দোলনেও ভুমিকা রাখেন এই কলেজের শিক্ষার্থীরা। মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানীর জমিওতে উলামায়ে হিন্দের ৩ জন নেতা আসাম পার্লামেন্টারি সদস্য থাকায় উনারা চাচ্ছিলেন সিলেট আসামের সাথেই ভারতে থাকবে। অন্যদিকে মুসলিম লিগের লাহুর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় সিলেট অঞ্চল পাকিস্তানের সাথে নাকি ভারতের সাথে যাবে তা নিয়ে রেফারেন্ডাম অনুস্টিত হয়। সেখানে পাকিস্তানের সাথে যাওয়ার পক্ষে যারা অগ্রণী ভুমিকা পালনকরেন দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফসহ সিলেটের অধিকাংশ নেতারাই এই কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী।স্বাধীন পাকিস্তান পুনর্ঘটন ও উন্নততর করনে অন্যতম ভুমিকা পালনকারী এই কলেজের সাবেক কৃতিছাত্র আলতাফ হোসেইন পাকিস্তানের শিল্পমন্ত্রীর দায়ীত্ত পালন করেন।
অনেক সংগ্রাম সাধনায় পাওয়া মুসিলিমদের জন্যে পৃথক আবাসভুমি পাকিস্তানেও ব্রিটিশ আমলে সৃষ্ট নিপীড়নমুলক জমিদারী প্রথার বিলুপ্তি হয়নি। দরিদ্র কৃষকদের উপর নিপীড়ন বন্ধে সিলেটের লাউতায় সংঘটিত হয় ‘নানকার বিদ্রোহ’। এই আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনায় কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষকে সংঘটিত করনে পঁয়তাল্লিশ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি ঘটিত হয়। কমিটির সম্পাদকের দায়ীত্ত পালন করেন এম সি কলেজের সাবেক ছাত্র বপ্লবী অজয় ভট্টাচার্য।
দেশ ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে যে বিষয়টি সবচেয়ে বড় আন্দোলনের ইস্যু হিসেবে সামনে আসে সেটি ছিল ভাষার দাবী। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সর্বপ্রথম দাবীই উত্তাপিত সিলেট থেকে।সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্যসংসদের মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত আল -ইসলাহ পত্রিকার সম্পাদক জনাব নুরুল হক এই দাবি দেশের মধ্যে সর্রবপ্রথম লিখিত আকারে প্রকাশ করেন। তার পর তমদ্দুন মজলিস দেশব্যাপী ভাষার দাবীতে আন্দোলনের ডাক দিলে সিলেটের এম সি কলেজ থেকে ছাত্ররা কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ করে নিয়মিত কর্মসুচী পালন করতে শুরু করেন।এমসি কলেজের ছাত্র অধ্যক্ষ মাসউদ খান এই আন্দোলনের অন্যতম সিপাহশালার। ভাষার দাবীতে অন্দোলনে অংশগ্রহণ করায় গোবিন্দ পার্কে (বর্ত্তমান হাসান মার্কেট) তাকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
এই সকল আন্দোলন সংগ্রামের দারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ।এই যুদ্ধে স্তানীয় ও জাতীয়ভাবে অসামান্য অবধান রাখেন এম সি কলেজের শিক্ষার্থীরা।
সেই কঠিন সময়ে এমসি কলেজ ছাত্রসংসদের ভিপি ছিলেন বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত সিরাজুল ইসলাম। ২৫শে মার্চ কালো রাতে যখন সারা দেশে কার্ফ্যু জারিহয় তারই নেতৃত্তে এমসি কলেজ শিক্ষার্থীরা জীবন বাজী রেখে সিলেট নগরীর টিলাগর এবং বালুচরে রাস্তা ব্যারিকেড দিয়ে নিজেরা যুদ্ধেজাপিয়ে পরেন দেশ ও জাতীকে মুক্ত করার লড়াইয়ে।
কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী এম এ রব বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সহ-সর্বাধিনায়কের দায়ীত্ত পালন করেন । স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর উত্তম খেতাব প্রদান করে।এছাড়া ২০০০ সালে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক ২০০০ দেয়া হয়।
অন্যতম সেক্টর কমান্ডারের দায়ীত্ত পালন করেন এই কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী কর্ণেল আবু তাহের। বাংলাদেশ সরকার যাকে বীরউত্তম উপাধি প্রদান করেন। আরও অনেক খ্যাতিমান দেশপ্রেমিক উপাহার দিয়েছে এই কলেজ।সিলেট অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের পরিসমাপ্তি সংঘটিত হয় এই কলেজকে ঘিরেই।
মহান মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শেষ প্রান্তে ১৫ ডিসেম্বর রাত পোহানোর সাথে সাথেই সিলেট শহরজুড়ে বিরাজ করছিল উত্তেজনা। প্রতীক্ষার প্রহর যেন ফুরায় না। অবশেষে সিদ্ধান্ত অনুসারে এমসি কলেজ মাঠেই পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতাকে কাজে লাগাতে সর্বপ্রথম একটি সুন্দর দেশ ঘটনে প্রয়োজন ছিলো একটি সঠিক সংবিধান প্রণয়ন। আর তাতে যারা ভুমিকা রাখেন উনাদের অন্যতম ছিলেন এম সি কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী বাবু সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত।
স্বাধীনতা উত্তর দেশের প্রতিটি সংসদ এবং মন্ত্রীসভার গুরুত্তপূর্ণ সদস্য হিসেবে দেশ ও জাতীর ক্রান্তিলগ্নে দায়ীত্ত পালন করেন এই কলেজ থেকে শিক্ষাজীবন সমাপ্তকারী শিক্ষার্থীরা। অর্থনৈতিক সমস্যাগ্রস্ত একটি দেশের সবচেয়ে কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং কাজ হচ্ছে বাজেট প্রণয়ন।বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশী সংখ্যকবার বাজেট পেশককারী দুই অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান এবং আবুল মাল আবদুল মুহিত এই কলেজের সাবেক কৃতিছাত্র।
কলেজের সাবেক দুই কৃতীছাত্র বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের বিশেষ তত্ত্বাবধানে এবং অর্থমন্ত্রী এম এ মুহিতের আন্তরিকতায় এমসি কলেজ আবারও তার স্বগৌরবে লক্ষ্যপানে এগিয়ে চলছে। এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানীখ্যাত সিলেটের উচ্চশিক্ষার উজ্জ্বল প্রদীপটি তার সুনির্দিষ্ট মঞ্জিল পানে।
লেখক ঃ সাংবাদিক
শিক্ষার্থী, রসায়নবিদ্যা বিভাগ,
এম সি কলেজ সিলেট।
. . . . . . . . .