দোয়ারাবাজারে ভয়াবহ বন্যার ১ বছর,ক্ষতিগ্রস্ত অর্ধলক্ষ পরিবার

সোহেল মিয়া,দোয়ারাবাজার(সুনামগঞ্জ)
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ জুন ২০২৩, ৯:৩৯ অপরাহ্ণআজ ১৬ই জুন-২০২৩ দোয়ারাবাজারে ভয়াবহ বন্যার একবছর। ২০২২ সালের আজকের এইদিনটি দোয়ারাবাজার উপজেলার সকল ধর্ম,পেশা ও বয়সের মানুষের জন্য স্মরনীয় হয়ে থাকবে। গত বছরের মে-জুন মাসটি ছিলো দূর্ভোগ-দূর্দশার। শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যায় ভেঙ্গেছে কয়েক হাজার দরিদ্র পরিবারের ঘর-বাড়ী। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ ও গবাদী পশু। স্বজন হারিয়েছে অনেক পরিবার।
বন্যার প্রলয়ঙ্করী রূপ দেখেছেন উপজেলার সকল শ্রেনী পেশার মানুষজন। পাহাড়ি ঢলের আঘাতে বসত-বাড়ী ছেড়ে জীবন রক্ষায় অনেকেই সড়ক-মহাসড়কে অনাহারে-অর্ধাহারে রাত কাটিয়েছেন।
গত বছরের ১৬ জুন সকাল থেকেই উপজেলার সকল নদ-নদী ও হাওড়ের পানি বেড়ে দোয়ারাবাজারের সাথে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। রাতেই ডুবে যায় উপজেলার গ্রামাঞ্চলের ৯০ ভাগ এলাকা। জনসাধারনকে বাঁচাতে খুলে দেওয়া হয় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ২২ জুন পর্যন্ত উপজেলার বন্যায় প্রায় ৩ লাখ মানুষ পানিবন্ধি হয়েছিলেন। বিপর্যস্থ অসহায় মানুষদের বাঁচাতে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনী তলব করা হয়। ওই বন্যায় উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের অর্ধলক্ষ পরিবার বসতঘর ও গবাদিপশু হারিয়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন
১২২ বছরের ইতিহাসে এরকম বন্যার তান্ডব দেখা যায়নি। সবচেয়ে বেশী বিপদে পড়তে হয়েছে উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিম্ম আয়ের হাজার হাজার পরিবারের। মাত্র ২৪ ঘন্টায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। মুহুর্তেও মধ্যে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন লাখো পরিবার। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বিদ্যুৎ, গ্যাস, মুঠোফোন নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবা। জনজীবনের স্বাভাবিক কার্যক্রমে নেমে আসে স্থবিরতা। হাটবাজার-দোকানপাট বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় নিত্যপণ্য কেনারও সুযোগ ছিল না। দেখা দেয় খাবার পানির তীব্র সংকট।
ইঞ্জিন চালিত নৌকা নিয়ে আত্মীয়দের বন্যার কবল থেকে উদ্ধার করতে গিয়ে বন্যার পানির তোড়ে ভেসে গিয়ে ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম নামের নরসিংপুর এলাকার এক বাসিন্দা । ১২ ঘণ্টা ভেসে থাকার পর নৌকাতে থাকা ৪ জন আশ্রয় নিয়ে ছিলেন একটি টিলাতে। তাদের রাত কেটেছে টিলাতেই। ক্ষুধা নিবারণের জন্য তারা কিছু খেতে পায়নি।
এভাবে লড়াই করে ১৬ ঘণ্টা পর উদ্ধার পেয়েছেন স্থানীয়দের সহায়তায়।
উপজেলার নরসিংপুর ইউনিয়নের হাবিবনগর গ্রামের দিনমুজুর আব্দুল বারেক (৬০) বলেন, বাড়ী-ঘর সব পানিতে ভাইস্যা গেছে। ৬দিন পর গ্রামে গিয়ে দেখি বসত-ঘরের কিছুই নেই, শুধু ঘরের খুটি গুলো নড়তে আছে। এই গ্রামের আব্দুল বারেক’র মতো উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের শত শত পরিবার বন্যায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হলেও বন্যার ১ বছর পার এখনও ঘুরে দাড়াতে পারেননি।
উপজেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী,৯টি ইউনিয়ন বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েন প্রায় ৩ লাখ মানুষ। পুরো উপজেলায় বন্যায় ১ হাজারের ও বেশি ঘর-বাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্থ হয়। মারা যায় কয়েকশতাধিক গবাদি পশু । প্রায় ৫০০ হেক্টর জমির ফসলহানি হয়।। অর্ধশতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্টানের ব্যাপক ক্ষতির পাশাপাশি বেশ কয়েকটি মসজিদ ও মন্দিরের ক্ষতি হয়েছে। গ্রামীন সড়ক যোগযোগের ক্ষেত্রে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার সড়কপথ ও বেশ কয়েকটি কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। প্রায় ৫ হাজারের ও অধিক পুকুর ও জলাশয়ের মাছ ভেসে গেছে।
সরকারী হিসেব অনুযায়ী ক্ষয়-ক্ষতির পরিমান ১’শত কোটি টাকার মতো ধরা হলেও বেসরকারী হিসেবে ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ এর দ্বিগুন। বন্যার পর ক্ষতিগ্রস্থদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ বাড়ী বিধ্বস্থ পরিবারকে প্রথম ধাপে জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা করে ৫৭৫টি পরিবারে টাকা বন্টন করা হয়।
স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ বন্যা কবলিতদের সহায়তায় নিবেদিত ছিলেন। টানা প্রায় এক সপ্তাহ থানা সেনাবাহিনী, পুলিশ,সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনসহ বিত্তবানদের পক্ষ থেকে বাড়ী বাড়ী গিয়ে বন্যা দূর্গত এলাকায় রান্না করা খাবারসহ খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। বানভাসিদের চারদিকে যখন হাহাকার, তখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছুটে আসা গাড়ী ও ট্রলার ভর্তি ত্রাণ নিয়ে বিপদগ্রস্ত মানুষকে সাহস জুগিয়েছেন বিত্তশালী একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।
সারাদেশসংবাদ/হান্নান