ইফতার পলিটিক্সে জাপা – বিএনপি কাছাকাছি

ইয়াহিয়া নয়ন
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ এপ্রিল ২০২৩, ৬:৫৮ অপরাহ্ণরাজনীতিতে শেষকথা বলে কিছু নেই। জাতীয় পার্টির সাথে বিএনপির মুখ দেখাদেখি নেই গত দশ বছর। সামনে নির্বাচন, জোট গড়তে ভোট আছে এমন রাজনৈতিক দলের সাথে মিত্রতা চাইছে বিএনপি। ঠিক এমন সময়ে সোমবার রাজধানীর ইস্কাটন লেডিস ক্লাবে রাজনীতিবিদদের সম্মানে বিএনপি আয়োজিত ইফতার মাহফিলে যোগ দিয়েছে জাতীয় পার্টি। ইফতার মাহফিলে জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো:চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এমপি, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু এমপি, কো: চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ এমপি ও ফখরুল ইমাম এমপি জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে অংশ নেন। এর আগের দিন ২ এপ্রিল রাজধানীর হোটেল র্যাডিসনে জাতীয় পার্টি আয়োজিত ইফতার মাহফিলে অংশ নেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ড. আব্দুল মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান মনিরুল হক চৌধুরী , ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহবায়ক আব্দুস সালাম।
সরকারের পদত্যাগের আন্দোলনে রাজপথে সরব থাকা বিএনপি। অথচ আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের মিত্রশক্তি সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির নেতারা হঠাৎ করে একে অন্যের ইফতারে অংশ নিয়েছে এবং ঘরোয়া আলোচনা করেছে। এই খবরে রাজনৈতিক অঙ্গনে যেমন নানা গুঞ্জনের সৃস্টি হয়েছে। অপরদিকে দুরুত্ব কমিয়ে ইফতার পার্টির মাধ্যমে বিএনপি-জাতীয় পার্টি একে অন্যোর কাছাকাছি অবস্থানে যাওয়ায় এবং নিজেদের মধ্যে ঘরোয়া আলাপে আগামীতে দেশের জাতীয় রাজনীতিতে নয়া মেরুকরনের আভাস মিলছে বলে মনে করছেন দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। একই সঙ্গে জাতীয় পার্টির ইফতারে বিএনপির পাশাপাশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে বাম-ডান ও মধ্যপন্থি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের ব্যাপক সংখ্যায় উপস্থিতিও আগামী রাজনীতির জন্য ইতিবাচক বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিশিষ্টজনেরা।
এই ব্যাপারে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপার্চায ও দেশের বরেণ্য রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ মিডিয়াকে বলেন, জাতীয় পার্টির ইফতারে আমন্ত্রিত হয়ে আমি নিজে অংশ নিয়েছিলাম। ইফতারে আমি দেখেছি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একাধিক শীর্ষস্থানীয় নেতা অংশ নিয়েছেন। এছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সিনিয়র নেতাদের উপস্থিতিও ছিলো চোখে পড়ার মতো। দীর্ঘদিন পর হলেও জাতীয় পার্টির ইফতারের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন মতের রাজনৈতিক দলের নেতাদের একত্রিত হওয়াকে আমি ইতিবাচক হিসেবে দেখি। আমি মনে করি বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে যে সংকট চলছে তা অবশ্যই রাজনৈতিক সংলাপ বা আলোচনার মধ্য দিয়ে নিরসন হবে । বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে আলাপ, আলোচনা সৌর্হাদ্যতা যতই বাড়বে ততই সমঝোতার ইঙ্গিত বহন করবে। যা রাজনীতি ও দেশের জন্য অত্যন্ত শুভ। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে ড. কলিমুল্লাহ বলেন, বিএনপির ইফতারে জাতীয় পার্টির নেতাদের অংশ গ্রহণও ইতিবাচক। আমি মনে করি, আওয়ামী লীগকে নিমন্ত্রণ করলেও তারা হয়তো বিএনপির ইফতারে অংশ নিতো। তবে যেহেতু ইফতার পার্টি একটি ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠান তাই এখানে জোটের রাজনীতির পরিধি বৃদ্ধির বিষয়টি অবান্তর।
খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মধ্য আদর্শগত মিল থাকলেও দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে মূলত দল দুইটি নিজেদের মধ্যে যোজন যোজন দুরুত্ব বজায় রেখে রাজনীতি করছিলো। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টি কৌশলগত ঐক্য করে নির্বাচন ও সরকারর গঠনের ফলে বিএনপির সঙ্গে অনানুষ্ঠনিক দুরুত্ব সৃষ্টি হয় জাতীয় পার্টির সঙ্গে। ফলে সর্বশেষ ২০১৩ সালে জাপার ইফতারে যোগদানের পর বিগত ১০ বছরে কয়েকবার আমন্ত্রণ জানানোর পরও জাপার কোনো ইফতার বা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগ দেয়নি বিএনপি। অপরদিকে জাতীয় পার্টিকে আমন্ত্রণ জানানোর পরও দলটির কোনো নেতা বিগত ১০ বছরে বিএনপির ইফতার বা অন্য কোনো কর্মসূচিতে যোগদেননি।
সোমবার রাজধানীর লেডিস ক্লাবে আয়োজিত বিএনপির ইফতারে জাতীয় পার্টি ছাড়াও অংশ নেন এলডিপির কর্নেল অলি আহমদ, জেএসডির আ স ম আব্দুর রব, মিসেস তানিয়া রব, ড. রেদোয়ান আহমেদ, গণফোরামের মোস্তফা মোহসীন মন্টু, সুব্রত চৌধুরী, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, এনপিপির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, বিকল্প ধারা বাংলাদেশের অধ্যাপক নূরুল আমিন বেপারীসহ আন্দোলনরত ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের নেতারা।
অপর দিকে জাতীয় পার্টির ইফতারে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কৃষি মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া ছাড়াও সরকারের শরীক দলের নেতাদের মধ্যে অংশ নেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় পার্টি (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম, বিকল্প ধারা বাংলাদেশের মহাসচিব মেজর অব: আব্দুল মান্নান । এছাড়া কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, জেএসডি সভাপতি আসম আব্দুর রব,গণফোরামের সভাপতি মোস্তফা মহসিন মন্টুসহ অনেক রাজনীতিবীদ অংশ নেন। বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এবার অতিথিদের উপস্থিতি ছিল বেশ লক্ষ্যণীয়।
ইফতারে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলীয় উপনেতা জিএম কাদের এমপি বলেছেন, বর্তমানে বিশ্ব পরিস্থিতি এক ভয়াবহ অবস্থা অতিবাহিত করছে। আমরা চাই, পবিত্র এই মাহে রমজানে সবার শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। আমরা যেনো এই পৃথিবীতে শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান করতে পারি।
২০১৮ সাল থেকে ২০ দলীয় জোট কোনো কর্মসূচি পালন করেনি। তবে বিএনপি নিজেদের মতো করে বিক্ষোভ করেছে এবং জামায়াত ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করেছে।২০ দলীয় জোটকে কার্যকর করার পরিবর্তে নির্দলীয় সরকারে অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচনের দাবি আদায়ে বিরোধী শক্তিগুলোর একটি ‘বৃহত্তর ঐক্য’ গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। দলের অভ্যন্তরীণরা বলছেন, দেশে ও বিদেশে জোটের অন্যতম শরীক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর যে অবস্থান সেটি মাথায় রেখে বিএনপি ২০ দলীয় জোটকে কার্যকর না করার কৌশল নিয়েছে।
বিএনপির নেতারা বলছেন, এই মুহূর্তে আমাদের প্রধান লক্ষ্য সব বিরোধী শক্তির মধ্যে বৃহত্তর ঐক্যের দিকে, যারা একযোগে আন্দোলন করবে। লক্ষ্য হবে সরকারকে উৎখাত করা এবং একটি নির্দলীয় অন্তর্র্বতী সরকারের অধীনে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা। এই কঠিন সময়ে, একটি যুগপৎ আন্দোলন অত্যন্ত প্রয়োজন।
বিএনপির সাথে জাতীয় পার্টির নেতাদের কি আলোচনা হয়েছে জানা যায়নি। তবে এখন সময়টা খুবই জটিল। জাতীয় পার্টি সরকারের মিত্র। সেই ক্ষেত্রে তারা বিরোধীদের সাথে একজোট হবে কিনা তা নিয়ে দুইমত আছে। এমনটা হলে জাতীয় পার্টি দুভাগ হয়ে যেতে পারে। পাশাপাশি সরকারের খড়গ কড়ে উঠতে পারে।
বিএনপি ভেতরে ভেতরে অনেক তদবির করেছে জাতীয় পার্টিকে আন্দোলনে পাশে রাখতে। জাপার অনেক নেতাই সরকারের কর্মকান্ডে ক্ষুব্ধ। কিন্তু সকলের মতামত একত্র করতে পারেনি জাপা। এখন হয়তো জাপা আন্দোলন নিয়ে ভাবছেনা। ভাবছে নির্বাচন নিয়ে। সেক্ষেত্রে নির্বচনে নেতৃত্বের প্রশ্নে জাপা নেতার অবস্থান নিশ্চিত হলে তারা বিএনপির পাশে থাকতে পারে।
সরকার চাইছে সব দল নির্বাচনে আসুক। দেশের ভেতরে বাইরে এই একটাই চাওয়া। সেক্ষেত্রে জাপাকে সাথে নিয়ে বিএনপি নির্বাচনে এলে সরকারের লাভ। রাজনীতির হাওয়া কোন দিকে যাবে তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাবেনা। সবারই নজর এখন জাতীয় পার্টি আর বিএনপির দিকে।
লেখক : সাংবাদিক, কলািমিস্ট।