প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর

অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:৫৩ পূর্বাহ্ণঅবশেষে শুরু হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বহুল প্রতীক্ষিত, প্রত্যাশিত, পর্যালোচিত এবং কোভিডের কারণে বিলম্বিত ভারত সফর। লেখাটি যখন লিখছি ততক্ষণে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীতে পৌঁছে গেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রধানমন্ত্রীর এই সফরকে ঘিরে যা প্রত্যাশিত, এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে তাও। সফরটিকে ব্যর্থ প্রমাণে আটঘাট বেঁধে নেমে পড়েছে একদল মানুষ। সাবেক বিরোধী দলের পার্মানেন্ট মহাসচিব তো এরই মধ্যে সেই ঘোষণাটি দিয়েও ফেলেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয় শংকরের একান্ত বৈঠকের ছবিটি সোশ্যাল মিডিয়ায় আসা মাত্র প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর শারীরিক অসুস্থতাজনিত অনুুপস্থিতির পেছনেও বাড়তি কোন কারণ আছে কিনা, তার ব্যবচ্ছেদ শুরু করে দিয়েছে আরেক দল মানুষ।
প্রধানমন্ত্রীকে নয়াদিল্লী বিমানবন্দরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রিসিভ না করতে আসাটাও আলোচকদের আশান্বিত করেছে। এর মধ্যেও তারা নেতিবাচক আলামত খুঁজতে শুরু করেছে। হতভাগার দল জানেও না যে, ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রটোকল অনুযায়ী সফররত বিদেশী রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানকে তার ভারতীয় প্রতিপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে রিসিভ করেন হায়দরারাবাদ হাউস অথবা স্টেট গেস্ট হাউসে।
বাংলাদেশের বেলায় এর ব্যতিক্রম হয়েছিল মাত্র দুবার। প্রথমবার, ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথে যখন নয়াদিল্লীতে যাত্রা বিরতি করেছিলেন। সেবার সব প্রটোকল ভেঙ্গে বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী।
আর দ্বিতীয়বার এমনটি ঘটেছিল যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রাষ্ট্রীয় প্রটোকল ভেঙ্গে দিল্লীতে বরণ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৭-তে। ২০১৯-এ প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে ভারত সফরের অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল। সেবারও মোদিজি বিমানবন্দরে আসেননি। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এটাই স্বাভাবিক, অন্যকিছু ব্যতিক্রম।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে ভারত কোন জায়গায় রাখছে তার প্রমাণ মেলে সেদেশের নামকরা দৈনিক আনন্দবাজারে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে। ২০১০ সালের তুলনায় বাংলাদেশে ভারতের ঋণ সহায়তা বেড়ে বর্তমানে বেড়েছে দশগুণ। ভারতের মোট বৈদেশিক সহায়তা ২৫ শতাংশই বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ। এরই মধ্যে দেশটি এক বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশের হাতে তুলে দিয়েছে, তাও এক শতাংশের চেয়েও কম সুদে, যে উদারতা বাংলাদেশকে দেখায়নি আর কোন বন্ধু রাষ্ট্র।
ভারতের বাংলাদেশকে বিনা-ট্যারিফে নেপাল ও ভুটানে পণ্য রফতানিতে ট্রানজিট সুবিধা দেয়াকে গণ্য করা হচ্ছে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার একটি বড় ধাপ হিসেবে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরটি ভারত ব্যবহার করতে পারায় এতে শুধু যে ভারতের সেভেন সিস্টার্সই উপকৃত হবে তা নয়, এর সুবিধা পাবে ঢাকাও। কারণ, এর ফলে উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশের রফতানি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে বলে প্রত্যাশা দিল্লীর সাউথ ব্লকের।
প্রধানমন্ত্রীর চলমান ভারত সফরে দ্বিতীয় দিন পর্যন্ত এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক বলে মনে হলেও আমার কাছে মনে হয়েছে এসবের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনেক নিগূর। যৌথভাবে রামপাল তাপবিদ্যুত কেন্দ্রের ইউনিট-১সহ ভারতীয় সহায়তাপুষ্ট চারটি প্রজেক্টের উদ্বোধন করেছেন দুই প্রধানমন্ত্রী। নানা ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য একাধিক সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষর হয়েছে। এর মধ্যে কুশিয়ারার পানি বণ্টন চুক্তিটি বিশেষ তাৎপর্যবহ।
তিস্তার পানি বণ্টনের চুক্তি না হওয়াটাকে যারা ভারতের সদিচ্ছার অভাব হিসেবে দেখাতে চান তাদের জন্য মেসেজটা পরিষ্কার। ভারত অভিন্ন নদীগুলোর পানিতে বাংলাদেশর ন্যায্য হিস্যা কখনই অস্বীকার করে না। তিস্তার সমস্যাটা একান্তভাবেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের কারণে ঝুলে আছে। আর ভারতের ফেডারেল কাঠামোয় রাজ্যকে পাশ কাটিয়ে এ ধরনের কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার কেন্দ্রের নেই।
ভারত সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ককে যে কোন জায়গায় নিতে যেতে চায় তাও এই সফরে পরিষ্কার হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের সঙ্গে কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট, সংক্ষেপে সেপা স্বাক্ষরের ঘোষণা দিয়েছেন। এর ফলে দুই দেশের উৎপাদিত পণ্য দুই দেশেরই শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে।
ধারণা করা হচ্ছে এতে দুদেশের বাণিজ্যের পরিমাণ আগামী দশ বছরের মধ্যে বর্তমানের ১.৪ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ১৫ বিলিয়নে। ভারতের কাছে সেপা বাস্তবায়নের অনুরোধ ছিল জাপান এবং চীনের তরফ থেকেও। কিন্তু ভারত জাপান কিংবা চীনের আগে বেছে নিয়েছে তাদের চতুর্থ বৃহত্তম বাণিজ্যিক শরিক বাংলাদেশকে। পাশাপাশি সামনের দিনগুলোতে দুদেশের সহযোগিতার জায়গাটা প্রসারিত হতে যাচ্ছে মহাশূন্যেও। সহযোগিতার সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং প্রসার ভারতীর মধ্যেও।
এই জিনিসগুলো নিঃসন্দেহে অত্যন্ত তাৎপর্যবহ। কারণ, বোঝাই যাচ্ছে যে, দুদেশ তাদের সম্পর্ককে যে শুধু আরও উঁচুতে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর তাই নয়, পাশাপাশি তারা দুদেশের মানুষের একে অপরকে আরও ভাল করে চেনার-জানার-বোঝার ক্ষেত্রটাও তৈরি করতে যাচ্ছে।
আমাদের তরফ থেকেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিগন্যাল পাওয়া গেছে এই সফরে। প্রধানমন্ত্রী এবার হায়দরাবাদ হাউসে প্রথা ভেঙ্গে ইংরেজীর পাশাপাশি হিন্দী এবং বাংলাতে বক্তব্য রেখেছেন। হিন্দীতে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শেষে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর নয়াদিল্লীতে ছয় বছরের শরণার্থী জীবনে তার এই হিন্দী শেখা। পাশাপাশি এ সফরে তিনি নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজারও জিয়ারত করেছেন।
শরণার্থী জীবনে প্রধানমন্ত্রী দিল্লীতে যে জায়গাটায় থাকতেন, সেখান থেকে এই মাজারের দূরত্ব দুই কিলোমিটারেরও কম। সে সময়টায় এই মাজারে প্রায়ই যাওয়া হতো তার। তিনি বলেছেন, তিনি এবং পঁচাত্তরের হত্যাকা-ের শিকার পরিবারগুলোর সদস্যরা সে সময়ে মর্মাহত অবস্থায় ভারতে এসে স্বস্তির আশ্রয় পেয়েছিলেন। এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী ভারতের প্রতি বাংলাদেশ এবং তার ঋণের কথা শিকার করে নিলেন ঠিক যেমনটি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথে দিল্লীর জনসভায় শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর উপস্থিতিতে।
তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন যখন একদল লোক প্রধানমন্ত্রীর এই উদারতা আর বড়ত্বকে ভারতের কাছে নতজানু হবার উদাহরণ হিসেবে বিক্রি করতে চাইবে, তখন প্রধানমন্ত্রী প্রথমবারের মতো হায়দরাবাদ হাউসে বাংলায় বক্তব্য দিয়ে পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে তিনি ‘শেখের বেটি’। তার প্রয়াত পিতার মতোই তিনি সমতার ভিত্তিতেই ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ থেকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে দুদেশের মানুষের কল্যাণে সামনে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে চান।
প্রধানমন্ত্রী এবারের ভারত সফরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি হলো একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভারতীয়দের পরিবারের সদস্যদের জন্য ‘মুজিব বৃত্তি’ প্রদান। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ আর ভারতের সহযোগিতা আরও নানা উচ্চতায় উন্নীত হবে। খুঁজে পাবে নতুন নতুন ডাইমেনশনও। ভবিষ্যতে চলার পথে দুদেশ খুঁজে পাবে নতুন নতুন মিত্র আর উন্নয়ন সহযোগীও।
কিন্তু বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য ভারত সরকারের ‘মুক্তিযোদ্ধা স্কলারশিপ’ আর একাত্তরের ভারতীয় ওয়ারভেটেরানদের পরিবারের সদস্যদের জন্য বাংলাদেশ সরকারের ‘মুজিব বৃত্তি’- এই দুটি দেশের সম্পর্কের অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতকে নির্ধারণ করে দিয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক গত পঞ্চাশ বছরে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আজ যে পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে তা ফুলের সামান্য টোকায় বা সামান্য ভুলে যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা এদেশীয় কিছু অর্বাচীন-টাইপ মানুষের মগজে ঢোকানোটা খুব কঠিন।
এক সময় এরাই ভারতে বিজেপির সরকার গঠনে ঢাকার রাজপথে মিষ্টি বিলিয়েছিল। কারণ তাদের ধারণা ছিল বিজেপি এসে তাদের কোলে করে তেজগাঁওয়ের ঐ বড় দফতরটিতে পৌঁছে দেবে। এরাই এখন আবার একজন মন্ত্রীর বেফাঁস একটি উক্তিকে ধরে নিয়ে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের ধারাবাহিকতার পেছনে ভারতীয় মেকানিজমের গন্ধ খুঁজে ফিরছে। জনগণের ওপর এদের আস্থা শূন্যেরও নিচে। ক্ষমতায় যাওয়ার রাস্তা খুঁজতে এরা তাই বারবার গিয়ে ঠেকে গুলশান-বারিধারার দূতাবাসগুলোয়।
এরা যেটা বোঝে না তা হলো, আওয়ামী লীগের শক্তির উৎস জনগণ। আর ভারত-বাংলাদেশের যে মৈত্রী, তা সরকারের-সরকারের নয়। এই মৈত্রী দুদেশের জনগণের এবং তা দাঁড়িয়ে আছে এই দুটি দেশের শহীদদের রক্তের ওপর। কে কবে এই দুই দেশের ক্ষমতায় এলো গেল, তাতে এই মৈত্রীর বন্ধনে কোন ছেদ পড়েনি। আর পড়বেও না কোনদিন।
লেখক : ডিভিশন প্রধান,ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ