রমজান মাসে লিভার সিরোসিস রোগীরা কী খাবেন, কী খাবেন না

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ এপ্রিল ২০২২, ১২:৪৭ অপরাহ্ণআমরা জানি নানা কারণে লিভার সিরোসিস হয়ে থাকে। লিভার সিরোসিস যখন হয়ে যায় তখন লিভার তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। লিভারে পার্মানেন্ট ডেমেজ দেখা দেয়। একেই আমরা লিভার সিরোসিস বলি। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে হেপাটাইটিস বি-ভাইরাস, ফ্যাটি লিভার এবং হেপাটাইটিস সি-ভাইরাস লিভার সিরোসিসের মূল কারণ। এ সমস্ত রোগ লিভারে দীর্ঘমেয়াদে থাকে। যখন লিভারে দীর্ঘমেয়াদে হেপাটাইটিস বা টনিক হেপাটাইটিস অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহ তৈরি করে তখন একটা পর্যায়ে অনেকেরই লিভার সিরোসিস হয়। অর্থাৎ তাদের লিভারের যে স্বাভাবিক কাঠামো, আকার-আকৃতি আছে তা বিকৃত হয়ে পরে। লিভার তারপরও অনেকদিন তার স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যায়, কিন্তু একটা সময় লিভার আর তার কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পারে না। তখন আমরা বলি লিভার ফেইলিউর হয়েছে, পেটে পানি আসা, জন্ডিস ডেভেলপ করা, রক্ত বমি, এলোমেলো কথা বলা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া এরকম সমস্যা দেখা দেয়। যাদের ভাগ্য আরও খারাপ তাদের ফুসফুসে পানি আসতে পারে, রক্তবমি হতে পারে এবং একটা সময় সবার নয়, কারও কারও ক্ষেত্রে লিভারে টিউমার বা লিভারে ক্যান্সার হয়ে যেতে পারে।
লিভার সিরোসিসের রোগীদের খাবারের নিয়ম মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ তাদের চিকিৎসা বা মেনেজমেন্টে। কারণ যাদের পেটে পানি থাকে সে রোগীদের আমরা বলে দিই আপনারা পানিটা মেপে খাবেন কখনো দিনে দুই লিটারের বেশি পানি খাবেন না। আমরা তাদের পাতে লবন খেতে মানা করি, বেকিং সোডা, বেকিং পাউডার এমন সব খাবার, যেসব খাবারে প্রচুর গ্যাস থাকে সেসব খাবারও খেতে না করি। অনেক সময় এমন দেখা যায় অতিরিক্ত আমিষ বা প্রোটিন যারা খান সেসমস্ত লিভার সিরোসিসের রোগীরা যাদের লিভার ফেইলিউর আছে তাদের কথাবার্তা এলোমেলো হয়ে যায়, তাদের অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয় অনেকে অজ্ঞান হয়েও যায়। এই যে রোগীদের খাবারের সাথে লিভারের একটা যোগাযোগ এটার জন্য লিভার সিরোসিসের রোগীদের সাবধান থাকতে হবে। যাদের লিভারে সিরোসিস আছে কিন্তু লিভারটা ঠিকমতো কাজ করছে তারা রোজা হয়তো রাখতে পারবেন এবং রোজা রাখায় খুব একটা সমস্যা হবে না, যদি তারা সতর্ক থাকেন। পানি খেলে ফুটানো পানি খেতে হবে। কারণ পানির সাথে নানা রকম জীবাণু আমাদের শরীরে প্রবেশ করতে পারে। আমরা এখন দেখছি কীভাবে সারা দেশে কলেরা, ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। এছাড়াও হেপাটাইটিস এ ভাইরাস, ই ভাইরাস জাতীয় রোগগুলো আমাদের শরীরে দূষিত পানির মাধ্যমে ঢুকতে পারে।
ফলে একজন লিভার সিরোসিসের রোগী যদি পানির ব্যাপারে সতর্ক না থাকে তারা যদি এসময় পানি খেতে গিয়ে দূষিত পানি খান এবং তা থেকে এ বা ই ভাইরাসে আক্রান্ত হয় এবং তা লিভারে সংক্রমন করে ডায়রিয়া, কলেরা হয় তাহলে লিভারটা ফেইল করে যাওয়ার একটা বড় আশঙ্কা রয়ে যায়। যখন লিভার সিরোসিসের রোগীর পেটে যখন পানি চলে আসে, এলোমেলো কথা বলে তখন আমরা রোগীদের সাময়িকভাবে প্রাণিজ ও আমিষ কম খেতে বলি। এই রমজান মাসে যদি এরকম একটা লিভার সিরোসিসের রোগী এ ধরনের খাবারগুলো বেশি বেশি খান তাহলে তাদের লিভারে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। যারা ফ্যাটি লিভারের রোগী আছে, যাদের ফ্যাটি লিভার থেকে লিভার সিরোসিস হয়েছে তাদের খাবার আরও গুরুত্বপূর্ণ। তাদের অতিরিক্ত শর্করা খাওয়া চলবে না, চিনিটা কম করে খেতে হবে, মিষ্টি জাতীয় খাবার বাদ দিতে হবে, ভাত, পরোটা ইত্যাদি খাবার কম করে খেতে হবে, তেল চর্বির ব্যাপারে খুব সাবধান থাকতে হবে। এই তেল চর্বি জাতীয় খাবার লিভারে আরও অতিরিক্ত চর্বি জমতে সাহায্য করবে এবং লিভারটাকে খারাপ করে দিবে।
আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যাদের লিভার সিরোসিস আছে তাদের বাইরের খাবারের ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকতে হবে। তাদের বাইরের খাবার খাওয়া যাবে না, খেলে গরম খাবার খেতে হবে, পানি খেলে ফুটানো পানি বা টিউবওয়েলের পানি খেতে হবে। অর্থাৎ, একজন লিভার সিরোসিসের রোগীর মনে রাখতে হবে রমজানটা তার জন্য একটা আশির্বাদ হয়ে এসেছে তবে এসব নিয়ম-কানুন তাকে সব মেনে চলতে হবে। কারণ তিনি যদি তার খাবারের ব্যাপারে অসচেতন হয়ে পরেন, পানির ব্যাপারে সতর্ক না থাকেন, তিনি যদি বাইরে থেকে যত্রতত্র খাবার কিনে খাওয়া শুরু করেন, তার যদি খাবারে অতিরিক্ত শর্করা থাকে তাহলে এটা তার উপর খুবই খারাপ প্রভাব ফেলবে। এই নিয়মগুলা বিশেষ করে ফ্যাটি লিভার বা লিভার সিরোসিসের রোগীদের ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য। যাদের অবস্থা বেশি খারাপ তারা যদি শর্করা, আমিষ জাতীয় খাবার বেশি খেয়ে ফেলে তাহলে তাদের বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। সমস্যাটা হচ্ছে লিভার খারাপ হওয়ার পরও ভালোভাবে কাজ করে যায় কিন্তু একবার যদি এ ধরনের সমস্যা দেখা দেয় তাখন লিভারের পক্ষে আবার ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে পরে। লিভার সিরোসিসের রোগীদের কাছে অনুরোধ থাকবে আপনারা যদি রোজা রাখতে চান তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রোজা রাখুন কিন্তু রোজা রেখে খাবারের ব্যাপারে খুব সাবধান থাকতে হবে, পানির ব্যাপারে খুব সাবধান হতে হবে, না হলে খুব সমস্যা হয়ে যাবে।
পরিচিতি: ডিভিশন হেড, ইন্টারভেনশন হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। শ্রুতিলিখন: জান্নাতুল ফেরদৌস