ফারাক্কা দিবসের ভাবনা
সিলেটের কন্ঠ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ মে ২০২১, ৬:৩৫ অপরাহ্ণএমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম
ভারতবর্ষের রাজনীতিতে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী অনশন ধর্মঘটকে সংযুক্ত করেছিলেন। অহিংসবাদী গান্ধীজী নিজে অভুক্ত থেকে বৃটিশরাজের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে রাজনীতির অঙ্গনে এই নবতর কর্মসূচিকে অভিষিক্ত করেন । মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী অবিভক্ত পাকিস্তানের রাজনৈতিক অভিধানে ঘেরাও আন্দেলনের অন্তর্ভুক্তি ঘটান।
প্রফেট অব ভায়োল্যান্স খ্যাত মওলানা ১৯৬৮ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে লাটভবন ঘেরাওয়ের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচার বিরোধী জনমতকে আরেকটি পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন। ঘেরাও আন্দোলনের জনক মওলানা ভাসানী জীবনের শেষ অংকে এসে লংমার্চ শব্দটিকেও বাস্তবে রূপ দেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও সেতুঙের নেতৃত্বে দেশের একপ্রান্ত থেকে শেষসীমানা পর্যন্ত বছরব্যাপী যে সুদীর্ঘ গণঅভিযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইতিহাসে তালংমার্চ নামে পরিচিত। ১৯৩৪ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৩৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত চলমান জনসে ্রাত চিয়াংশি প্রদেশ থেকে শুরু হয়ে ০৬ হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে পীত নদীর তীরে শেনসি প্রদেশে সমাপ্ত হয়েছিল।
পথিমধ্যে ১৮টি পর্বতমালা ও ২৪টি নদী অতিক্রম করেছিলেন অভিযাত্রীরা । কমরেড মাও সেতুঙ পরিচালিত লংমার্চের উদ্দেশ্য ছিল শতকোটি মানুষকে জাপানী সম্রাজ্যবাদ ও দেশীয় সামন্তবাদের বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করে
গণজাগরণ সৃষ্টি করা। চীনের লংমার্চ অভূতপূর্বভাবে সফল হয়েছিল এবং ১৯৪৯ সালে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আফিমখোর চীনাজাতি অর্জন করেছিল জাতীয়মুক্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র।
ভারতকর্তৃক পশ্চিমবাংলার মালদহ জেলায় ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণক্রমে গঙ্গানদীর পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে হুগলী ও ভগিরথী নদীতে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চল, রাজশাহী তথা উত্তরবঙ্গকে মরুভূমিতে পরিণত করার অশনি তৎপরতার প্রতিবাদে মওলানা ভাসানী ১৬ মে ঐতিহাসিক লংমার্চ অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়ায় এদেশের সংগ্রামমুখর মানুষকে পরিচয় করিয়ে দেন দীর্ঘ গণবিক্ষোভ মিছিল তথা লংমার্চ শব্দের সাথে।
রাজশাহী নগরীর মাদ্রসা ময়দান থেকে শুরু হওয়া এই লংমার্চ পায়ে হেঁটে ৫৮ মাইল অতিক্রম করে পৌঁছেছিল
সীমান্ত অঞ্চল কানসাটে। ফারাক্কা লংমার্চ আহবানের পূর্বে সকল প্রকার কূটনৈতিক রীতিনীতি অনুসরণ করে প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ মওলানা ভাসানী কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন ।
তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে পত্রদিয়ে ফারাক্কা বাঁধ চালু না করা, গঙ্গানদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ থেকে সকল প্রতিবন্ধকতা প্রত্যাহার এবংআন্তর্জাতিক নদী আইন মেনে নেওয়ার আহবান জানিয়ে সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। মিসেস গান্ধী পত্রের জবাব দিয়েছিলেন কিন্তুু দাবী মেনে নেননি।
তারপর দেশী-বিদেশী সাংবাদিক,কূটনীতিকদের উপস্থিতিতে অশীতিপর বৃদ্ধ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চে, যে গণমিছিল দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল আন্তর্জাতিক মহলের। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী জানতে পেরেছিলেন ফারাক্কা বাঁধের করূণ, নির্মম ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার।
যার ধারাবাহিকতায় দেশের একাংশ আজ মরুকরণ কবলিত। পাকশীতে ১৯১২ সালে নির্মিত প্রাচীন হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নীচে উন্মত্ত পদ্মা আজ ধূসর মরুভূমিসম। ফারাক্কা গণমিছিল শেষে ঢাকায় ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়েন এদেশে লংমার্চের প্রবক্তা সংগ্রামী নেতা ভাসানী এবং মাত্র ছয়মাসের মাথায় ১৭ নভেম্বর ১৯৭৬ তারিখে ৯৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন শতাব্দীর এই মহিরূহ।
মাওলানা ভাসানীর ইচ্ছে ছিল রাজশাহী থেকে ফিরে এসে ফারাক্কা বাঁধ বিরোধী দাবী উত্থাপনের জন্যে জাতিসংঘে ইংরেজী সাপ্তাহিক হলিডে সম্পাদক এনায়েতুল্লাহ খানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করা। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর কারণে তা আর হয়ে উঠেনি।
তবে দেশে, আঞ্চলিক রাজনীতিতে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফারাক্কা ইস্যু আজ পরিচিত, আলোচিত ও প্রতিষ্ঠিত। ফারাক্কা লংমার্চের সমসাময়িক ১৯৭৫ সালে মরক্কোর বাদশা হাসানের আহŸানে সাহারা মরুভূমিতে আরেকটি লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
ফারাক্কা এবং সাহারা লংমার্চ দু’টোই পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদীদের দ্বারা স্বীকৃত হয়েছে ও তাদের গবেষণায় স্থান পেয়েছে। ফারাক্কা লংমার্চের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে ‘‘ কাঁদে নদী, কাঁদে মানুষ ” নামে একটি শর্টফিল্ম নির্মিত হয়েছে।
যার মধ্যদিয়ে চিত্রিত হয়েছে বরেন্দ্র অঞ্চলের হাহাকার, ফারাক্কার অভিশাপ। ফারাক্কা লংমার্চের পরও ভারত বসে থাকেনি। বরাক, মনু, খোয়াই, ধরলা, গোমতী, মুহুরী, দুধকুমার ও তিস্তা সহ ৫৪টি অভিন্ন নদীর উজানে একে একে ব্যারেজ, এমবাকমেন্ট, ডাইক, সুইচগেট ইত্যাদি নির্মাণ করে নানাভাবে স্বাভাবিক পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে।
টিপাইমুখ বাঁধ ও তিস্তা ব্যারেজের প্রতিবাদে লংমার্চও হচ্ছে। কিন্তু না , এই লংমার্চগুলোর চরিত্র মৌলিকভাবে ফারাক্কা লংমার্চ থেকে আলাদা। বর্তমানে অধিকাংশ লংমার্চ হচ্ছে গাড়ীতে চড়ে। তাও আবার নেতারা বসে থাকেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত উচ্চাভিলাসী গাড়ীতে।
ফারাক্কা লংমার্চের চিড়া-গুড়, পথে পথে মাটির কলসীতে করে গ্রামবাসী কর্তৃক মিছিলকারীদের পানি পান করানো, অভুক্ত স্বেচ্ছাসেবী- এদের দেখা মিলেনা বর্তমান লংমার্চগুলোতে। অবশ্য চলমান সুবিধাবাদের কাছে গ্রাস হওয়া রাজনীতির যুগেও কিছু সংগঠন গণচীনের লংমার্চ, ফারাক্কা লংমার্চের আদলে আজও নি:স্বার্থভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলোকে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে অবিরত।
মনে হয় এরাই রাজনৈতিক, প্রতিবাদী, ত্যাগী তৎপরতার ভিতর দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন মওলানা ভাসানীকে। যদিও বর্তমানে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে মওলানা ভাসানীকে ধীরে ধীরে। ঢাকা নগরীর তেজগাঁও বিজয়সরণিতে ভাসানী নভোথিয়েটারের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।
স্কুলেরপাঠ্য পুস্তক থেকে ইতঃমধ্যে মওলানা ভাসানীর জীবনী বাদ পড়েছে অথবা সংক্ষিপ্ত হয়েছে। সন্তোষে প্রতিষ্ঠিত মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন অনুষদে তাঁর জীবনীর উপর নির্দিষ্ট মার্কসের পাঠ্য ছিল। তাও সংকোচিত হয়ে আসছে ক্রমান্বয়ে।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় মওলানা ভাসানী জনসমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছিলেন “ আজ যদি যমুনা নদীর উপর একটি সেতু থাকতো তাহলে সিরাজগঞ্জের চাষীদের উৎপাদিত পটল জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে পচতো না ”।
মওলানা ভাসানীর ঐ ভাষণ ছিল প্রশস্ত যমুনা নদীর উপর সেতু নির্মাণের স্বপ্ন দেখানো প্রথম বক্তব্য। জাতি আশা করেছিলেন যমুনা সেতুর স্বপ্নদ্রষ্টা মওলানা ভাসানীর নামে এর নামকরণ হবে; কিন্তুু তাঁর জন্মস্থান সিরাজগঞ্জেও তিনি উপেক্ষিত হলেন শেষ পর্যন্ত।
১৯৪৭ সালের পূর্বে সিলেট আসাম প্রদেশের অংশ ছিল এবং মওলানা ভাসানী ছিলেন আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি। ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা উত্তর ১৯৪৯ সালে তিনি ঢাকার রোজগার্ডেনে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেছিলেন, যার নাম ১৯৫৫ সালের অক্টোবরে মওলানা ভাসানীর
সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় কাউন্সিল সম্মেলনে পরিবর্তনক্রমে অসাম্প্রদায়িক নামকরণ আওয়ামী লীগ হয়।
আসামে মওলানা ভাসানী গোপীনাথ বড়দলই সরকার কর্তৃকপরিচালিত বাঙ্গাল খেদা এবং কুখ্যাত লাইন প্রথার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। আন্দোলনের একটি পর্যায়ে ভাষান চরের কৃষক সমাবেশের মধ্যদিয়ে তিনি পেয়েছিলেন ভাসানী অভিধা।
১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের সময় সিলেট জেলার পাঁচটি মহকুমা যথা: সিলেট সদর, সুনামগঞ্জ, করিমগঞ্জ,দক্ষিণ
সিলেট,এবং হবিগঞ্জকে পাকিসÍান অন্তর্ভুক্তিতে আসাম লীগ সভাপতি হিসেবে মাওলানা ভাসানী পালন করেন অনবদ্য ভূমিকা।
সিলেট ভারতে না পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হবে এবিষয়ে অনুষ্ঠিত গণভোটে পাকিস্তানভুক্তির পক্ষে গণরায় হলেও করিমগঞ্জ মহুকুমার বদরপুর, রাতাবাড়ি ও পাথারকান্দি সহ সাড়ে তিনটি থানা রহস্যময় কারণে চলে যায়
ভারতে।
সিলেট সদর, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও দক্ষিণ সিলেট মহুকুমা চারটি পাকিস্তান তথা পূর্ববাংলায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারায় আজ বাংলাদেশের মানচিত্রে স্থান করে নিতে পেরেছে। যতদিন বাংলাদেশ অভিন্ন নদীতে পানির হিস্যা থেকে বঞ্চিত হবে, ধনী-গরীবের মধ্যে বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িকতা থাকবে; ততদিন পানির জন্যে থাকবে সংগ্রাম, চলবে গরীবের লড়াই, প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক শক্তির পুনরুত্থান এবং এর মধ্যেই বেঁচে থাকবেন অগ্নিপুরুষ মওলানা ভাসানী।
লেখক: সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি