এবার রাংপানিতে দিনদুপুরে প্রকাশ্যে পাথর লুট

সিলেটের কন্ঠ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ আগস্ট ২০২৫, ৫:১৮ অপরাহ্ণসাদাপাথরের পর এবার পাথরখেকো চক্র তাণ্ডব চালাচ্ছে জৈন্তাপুরের রাংপানি এলাকায়। দিনেদুপুরে প্রকাশ্যে লুট করা হচ্ছে পাথর। বিজিবি সদস্যদের চোখের সামনেই পাথর লুটের এই কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে শত শত শ্রমিক। তবে কেউই তাদের বাধা দিচ্ছে না। এরই মধ্যে অনেকটা পাথরহীন হয়ে পড়েছে ওই এলাকা। বিশাল আকৃতির পাথরগুলো কেটে কেটে লুট করে নিয়ে যাচ্ছে বারকি শ্রমিকরা।
প্রশাসন বলছে, তারা বিভিন্ন ক্রাশার মিলে এখন অভিযান পরিচালনা করছে, সেজন্য রাংপানিতে যেতে সময় লাগছে। তবে পর্যায়ক্রমে তারা সেখানে অভিযান পরিচালনা করবে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এ পর্যটনকেন্দ্রটি সিলেট শহর থেকে প্রায় ৫৪ কিলোমিটার দূরে জৈন্তাপুর উপজেলার মোকামপুঞ্জি এলাকায় অবস্থিত। মেঘালয়ের জৈন্তা পাহাড়ের রংহংকং জলপ্রপাত থেকে স্বচ্ছ জলের থেকেই এর উৎপত্তি। এটি অনেকের কাছে শ্রীপুর পাথরকোয়ারি নামেও পরিচিত।
জৈন্তাপুর উপজেলার এসিল্যান্ড ফারজানা আক্তার লাবনী খোলা কাগজকে বলেন, ‘আমার এখন বিভিন্ন ক্রাশার মিলে অভিযান পরিচালনা করছি। সেজন্য রাংপানিতে যেতে সময় লাগছে। তবে পর্যায়ক্রমে সেখানে অভিযান পরিচালনা করা হবে।
আড়ালে প্রভাবশালীরা, পুলিশ ধরছে দিনমজুরদের
সিলেট পাথর লুটের ঘটনায় প্রভাবশালীদের নাম এলেও প্রশাসনের অভিযানে তাদের কেউই ধরা পড়ছেন না। এখন পর্যন্ত যাদের গ্রেফতার দেখানো হয়েছে তারা সবাই শ্রমিক। অভিযোগ, সাদাপাথরের প্রকৃত লুটেরা ও তাদের মদতদাতাদের আইনের আওতায় না এনে দিনমজুরদের হয়রানি করা হচ্ছে। যদিও পুলিশের দাবি যারা অভিযুক্ত শনাক্ত হচ্ছেন, তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে।
সূত্রের খবর- পাথর লুটপাটের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রাথমিকভাবে ১০৩ জনের একটি তালিকা তৈরি করেছে। ওই তালিকায় বিএনপি, আওয়ামী লীগ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক এবং একজন সাংবাদিকের নামও আছে। অবশ্য সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, ‘এটি প্রাথমিক তালিকা। যাচাই-বাছাই শেষে এটি চূড়ান্ত করা হবে। এরপর দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
এদিকে পাথর চুরি ও পাথর লুটপাটের ঘটনায় আরো চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এ সময় বিভিন্ন প্রকার দেশীয় অস্ত্র, ইয়ারগান ও মদ উদ্ধার করা হয়।
এর আগে গত শুক্রবার রাতে গ্রেফতার করা হয় আরো ৫ জনকে। এছাড়া রোববার সালুটিকর থেকে আর দুজনকে আটক করেছে যৌথ বাহিনী। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত পাথর লুটপাটের ঘটনায় গ্রেফতারের সংখ্যা ১১ জনে দাঁড়াল।
গ্রেফতাররা হলেন, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ আদর্শ গ্রামের মৃত আনোয়ার আলীর ছেলে কুতুব উদ্দিন ওরফে পাগলা শাহ (৫৪), উত্তরপাড়ার মৃত গোলাম মোস্তফার ছেলে আব্দুল ওয়াহিদ (৫৫), তার ছেলে জাহিদ আহমদ (২২), একই এলাকার আব্দুল ওয়াজেদের ছেলে রুহেল আহমদ (২৬) এবং আরেকজন সহযোগী।
কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনান বলেন, ‘সাদাপাথর চুরি ও লুটপাটের ঘটনায় পরিচালিত এই অভিযানে ৪ জনকে আটক করা হয়েছে। তাদেরকে রোববার আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে।’
অভিযুক্ত ইউএনও তদন্ত কমিটির সচিব, ক্ষোভ
এদিকে সাদাপাথর লুটের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জানা গেছে, সেই কমিটিতে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আজিজুন্নাহারকে রাখা হয়েছে। যার বিরুদ্ধে লুটপাট ঠেকাতে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তবে সিলেটের জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদ বলেছেন, কমিটিতে ইউএনও সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবেন। ইউএনওর যদি গাফিলতি থাকে তা খতিয়ে দেখা হবে। প্রমাণিত হলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, ইউএনও তদন্তে থাকলে মূল লুটেরারা চিহ্নিত হবে না। তাদের অভিযোগ, ইউএনও ও স্থানীয় প্রশাসনের যোগসাজশেই হয়েছে এই লুট। এখন যা হচ্ছে তা লোক দেখানো। স্থানীয়দের মতে, সাদাপাথর ও রেলওয়ে বাঙ্কার এ দুই স্থান থেকে কমপক্ষে দেড় কোটি ঘনফুট পাথর লুট হয়েছে, যার আনুমানিক মূল্য ২০০ কোটি টাকার বেশি।
স্থানীয় সূত্র জানায়, গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে সাদাপাথরে যে লুটপাট শুরু হয় তা থামাতে প্রশাসনের লোক দেখানো অভিযান ছাড়া কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। ইউএনও হিসাবে আজিজুন্নাহার যোগদান করেন এ বছরের ১৪ জানুয়ারি। এরপর অজানা কারণে সেই অভিযান আরো শিথিল হয়। এমন শিথিলতার কারণেই ধীরে ধীরে লুটপাটকারীরা তাদের লুটের মাত্রা আরো বাড়ায়।
গত কয়েকদিন এ নিয়ে সারা দেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এরপর নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। দোষীদের খুঁজতে গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। গত মঙ্গলবার সিলেটের জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদ ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন।
কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (উন্নয়ন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা) পদ্মাসেন সিংহ। দুই সদস্য হলেন কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও আজিজুন্নাহার ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক। কমিটিকে রোববারের (গতকাল) এর মধ্যে সরেজমিন পরিদর্শন করে জড়িতদের চিহ্নিত করতে এবং প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে তদন্ত কমিটি নির্ধারিত সময়ে রোববার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি। তদন্ত কমিটির আবেদনের প্রেক্ষিতে আগামী বুধবার পর্যন্ত সময় বর্ধিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ।
তিনি জানান, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা না দিয়ে সময় বাড়ানোর আবেদন করেছেন তদন্ত কমিটির প্রধান। এ আবেদনের প্রেক্ষিতে আগামী বুধবার পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে।
‘প্রশাসনের যোগসাজশে পাথর লুট’
এদিকে, সাদাপাথর লুটের ঘটনায় প্রশাসনের যোগসাজশ ছিল বলে মন্তব্য করেছেন সরকারের বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। গতকাল রোববার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি এ মন্তব্য করেন। উপদেষ্টা বলেন, এবার সর্বদলীয় ঐক্যের কারণে প্রশাসনের নিশ্চয়ই যোগসাজশ ছিল। তাহলে এখন তারা কীভাবে বের করতে পারে যে পাথরগুলো কোথায়? আবার নীরবতাও ছিল। তারা হয়তো এতটা ঝুঁকি নিতে পারছিল না।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, এখানে পাথর নিয়ে যে ঐক্যটা গড়ে উঠেছে সেই ঐক্যের বিপরীতে প্রশাসন হয়তো যোগসাজশ করেছে নতুবা নীরব থেকেছে বা দুটোই করেছে। সেজন্য প্রশাসনের ব্যাপারে আমরা ব্যবস্থা নেব কি না, দ্রুতই দেখতে পাবেন।
তিনি আরো বলেন, সরকারের কাজ নীতিমালা প্রণয়ন করা, আমরা কিন্তু সেই নীতিটি ঠিকই প্রণয়ন করেছি- যে এই ১৭টিতে পাথর উত্তোলন করা যাবে না। পাথর আদৌ উত্তোলন হচ্ছে কি না এটি দেখবে মাঠপর্যায়ের প্রশাসন। আমরা কিন্তু বারবার প্রশাসনকে বলেছি, লিখেছি।
সাড়ে ১২ হাজার ফুট পাথর উদ্ধার, ৫০টি নৌকা ধ্বংস
সিলেট সদর উপজেলার সালুটিকর ভাটা এলাকায় মাটিচাপা অবস্থায় অন্তত ১১ হাজার ঘনফুটেরও বেশি পাথরের জব্দ করেছে যৌথ বাহিনী। এসময় দুজনকে আটক করা হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে আটক দুইজনের নাম-পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। রোববার সকালে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রে আশিক মাহমুদ কবিরের নেতৃত্বে অভিযানে নামে যৌথ বাহিনী। অভিযানের এক পর্যায়ে ধোপাগুল সংলগ্ন সালুটিকর ভাটা এলাকায় একটি ক্রাশার মিলের আঙ্গিনায় মাটিচাপা অবস্থায় পাথরের সন্ধান পায়। জব্দকৃত পাথরের পরিমাণ ১১ হাজার ঘনফুট হতে পারে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এদিকে, সকালে গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং জুমপাড় এলাকায় অভিযান চালিয়ে আরো ১৫শ’ ঘনফুট পাথর উদ্ধার করা হয়েছে। পরে সেগুলো জুমপাড় জাফলং জিরো পয়েন্টে প্রতিস্থাপন করা হয়।
সিলেট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো. ফরহাদ উদ্দিনের নেতৃত্বে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত এখানে অভিযান চলে। অভিযানে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের জন্য কমপক্ষে ৫০টির নৌকা ধ্বংস করা হয়েছে।
গত বুধবার থেকে লুট ঠেকাতে ও পাথর উদ্ধারে কঠোর অবস্থানে নামে প্রশাসন। গত চার দিনে প্রায় পাঁচ লাখ ঘনফুট পাথর উদ্ধার করা হয়েছে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, ‘লুট হওয়া পাথর উদ্ধারে যৌথ বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে। লুটে জড়িত ব্যক্তিদের একটি প্রাথমিক তালিকা পুলিশ, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী করেছে। এখন যাচাই বাছাই করে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে।’