সিলেটে বোরোর বাম্পার ফলন, ন্যায্যমূল্য নিয়ে শঙ্কা

সিকডে
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ এপ্রিল ২০২৫, ৩:৩৭ অপরাহ্ণহাওরবেষ্টিত জেলা সুনামগঞ্জে চলতি মৌসুমে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে । ইতোমধ্যে জেলার সবকটি হাওরে ধান কাটা শুরু হয়েছে। বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, জগন্নাথপুরসহ জেলার সবকটি হাওরে চলছে ধান কাটার উৎসব। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবছর সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার ধান ঘরে তুলবে কৃষকরা।
এ বছর খরায় ধানের কিছু ক্ষতি হলেও ফলন ভালো হওয়ায় বেশ খুুুশি চাষিরা। পাশাপাশি বৈশাখ শুরুর আগেই চলতি বছর হাওরের ধান কাটতে পেরে হাসির ঝিলিক কৃষকদের মুখে।
সুনামগঞ্জ কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, চলতি বছর সুনামগঞ্জের ১৩৭টি হাওরে দুই লাখ ২৩ হাজার ৪১০ হেক্টর জমিতে বোর ধানের চাষাবাদ হয়েছে। যেখান থেকে চাল উৎপাদন হবে ৯ লাখ ২৪ হাজার ৪১৩ মেট্রিক টন যার বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে, সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলে ধান কাটা ও কেনাবেচা নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা। উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে কৃষকদের মধ্যে। এবছর সরকার প্রতি মণ ধানের মূল্য ১ হাজার ৪৪০ টাকা নির্ধারণ করেছে। তবে কৃষক আশঙ্কা, তারা হয়তো এই মূল্যও পাবেন না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার যদি প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এবং বেশি সংখ্যক কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান সংগ্রহ করে, তবেই কৃষকরা নির্ধারিত মূল্য পেতে পারেন। এতে মিলার ও ফড়িয়ারা বাধ্য হবেন উপযুক্ত মূল্যে কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনতে।
সদর উপজেলার লক্ষ্মণ শ্রী ইউনিয়নের কৃষক আশরাফ বলেন, এ বছর আবহাওয়া অনূকূলে থাকায় ফলন ভালো হয়েছে। আশা করছি আগামী এক সপ্তাহের সকল ধান ঘরে তুলতে পারবো। আমরা প্রতি বছর প্রায় ৫০ কেদার জমি চাষ করি। অন্য বছরের তুলনায় এবছর ভালো ফলন হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার করচার হাওরের মুক্তিখলা গ্রামের এক কৃষক জানান, ধান কাটার খরচ চালাতে অগ্রিম ৫০ হাজার টাকা নিয়েছেন। শর্ত অনুযায়ী, শুকনো ধান দেবেন ১ হাজার টাকা মণ দরে।
একই গ্রামের কৃষক মহিবুর রহমান বলেন, তিনি সাত একর জমিতে ধান চাষ করেছেন। এসব জমিতে প্রায় ১৫০ মণ ধান পাবেন বলে আশাবাদি তিনি। এরমধ্যে ১৫-২০ মণ ধান বাজারে বিক্রি করার পরিকল্পনা করেছেন। যদি সুযোগ মেলে, তবে সরকারি গোডাউনে এক টন ধান সরবরাহ করার ইচ্ছাও রয়েছে তার।
জামালগঞ্জ উপজেলার রহিমাপুর গ্রামের কৃষক মুকুল রায় জানান, এখনও শ্রমিক পাননি। ভরতপুর থেকে শ্রমিক আনতে চেষ্টা করছেন। শ্রমিকরা ৩০০ টাকা নগদ এবং সাত ভাগের এক ভাগ ফসল দাবি করছেন। যন্ত্রচালিত হারভেস্টার হাওরে নামছে না, ফলে তিনি বিপাকে পড়েছেন। ধান শুকিয়ে দুই-তিন ভাই মিলে দুই-তিন টন ধান বিক্রির পরিকল্পনা করছেন। তবে সরকারি গোডাউনে দেওয়ার সুযোগ পেলেই তা কাজে লাগাতে চান।
তাহিরপুর উপজেলার বড়দলের কৃষক সামায়ুন আহমদ বলেন, ‘আগের বছর ৫০-৬০ জন কৃষকের কৃষি কার্ড এক ব্যক্তির হাতে চলে গিয়েছিল। এই ধরনের টাউটরা-ই পরে ধান দিয়ে দেয়। সরকারি খাদ্য গুদামে ধান দিতে গেলে নানা অজুহাতে ফেরত পাঠানো হয় কৃষকদের।’ এ বছর যদি সঠিকভাবে সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে তিনি নিজেও সরকারি গুদামে ধান দেওয়ার চেষ্টা করবেন।
কৃষকদের দাবি ও সংগঠনগুলোর প্রস্তাবনা:
কৃষক সংগ্রাম সমিতির কেন্দ্রীয় নেতা খায়রুল বাশার ঠাকুর খান বলেন, বর্তমানে কৃষকরা ৮০ কেজি ভেজা ধানের বস্তা ৭৫ কেজি ধরে ৯০০ টাকায় খলায় বিক্রি করছেন। সরকার যদি ধান কেনা শুরু করে, তাহলে বাজার দর বাড়বে। তবে একজন কৃষকের কাছ থেকে এক-দুই টনের বেশি ধান না কেনার পরামর্শ দেন তিনি। যাতে প্রান্তিক কৃষকরা সুযোগ পান। কারণ তাদের হাতে বেশি ধান থাকেই না।
‘হাওরের কৃষি ও কৃষক বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ’-এর সভাপতি চিত্ত রঞ্জন তালুকদার বলেন, সরকারি ক্রয়কেন্দ্রগুলো দালাল ও ফড়িয়াদের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে। এই চিত্র বদলাতে হবে। হাওরে আগেভাগেই দাদনি পদ্ধতিতে (অগ্রিম কম দামে ধান কেনা) লক্ষ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করছে মহাজনেরা। পাশাপাশি সরকারি ক্রয়কেন্দ্রগুলো কৃষকদের জন্য দূরবর্তী হওয়ায় অনেকে আগ্রহ হারাচ্ছেন। তাই তিনি প্রস্তাব দেন, কৃষি সুপারভাইজারদের সহায়তায় গ্রামে গ্রামে গিয়ে শুকনো ধান সংগ্রহ করতে হবে। এতে পরিবহন ব্যয় কৃষকরাই বহন করলেও বাজারে স্বচ্ছতা আসবে।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, এবারও চার-পাঁচশ’ টাকা দিয়ে কৃষকদের কৃষি কার্ড কিনে নিচ্ছে দালালরা। এটি বন্ধ করতে প্রশাসন ও সচেতন নাগরিকদের সক্রিয় হতে হবে।
প্রশাসনের উদ্যোগ:
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোস্তফা ইকবাল আজাদ বলেন, সুনামগঞ্জে এ বছর বোরো ধানের ফলন ভালো হয়েছে। তবে কৃষকদের আমরা মাঠ পর্যায়ে পরামর্শ দিচ্ছি, যাতে তারা ৮০ শতাংশ ধান পাকলে সেটি কেটে ফেলে। এ বছর অন্য বছরের ন্যায় ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে।
তিনি আরও বলেন, এবার জেলায় হাওর ও নন-হাওর মিলিয়ে ২ লাখ ২৩ হাজার ৫০২ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ লাখ ৪৩ হাজার ৮৪ টন। এখন পর্যন্ত ৩০ শতাংশের বেশি জমির ধান কাটা হয়েছে। সরকারি ধান ক্রয় কার্যক্রম ২৪ এপ্রিল শুরু হবে। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে ১০৮ জন কৃষি সুপারভাইজার মাঠে কাজ করবেন। যাতে বেশি কৃষক সরকারি গুদামে ধান সরবরাহ করতে পারেন।
সুনামগঞ্জ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক হুমায়ুন কবির বলেন, জেলায় ১৪ হাজার ৬৪৫ মেট্রিক টন ধান ১ হাজার ৪৪০ টাকা মণ দরে সংগ্রহ করা হবে। একজন কৃষক ১২০ কেজি থেকে সর্বোচ্চ তিন টন পর্যন্ত ধান সরবরাহ করতে পারবেন। তবে স্থানীয় বাস্তবতায় প্রয়োজনে এই সীমা পরিবর্তন করা যেতে পারে।
সিলেট/আবির