খাদিমে পাহাড় ধসের শঙ্কায় ৮০ পরিবারের জীবন
সিলেটের কন্ঠ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ জুন ২০১৬, ২:২৬ পূর্বাহ্ণডেস্ক রিপোর্ট: একটু আগেই ঘরের বেড়া ধসে নিচে পড়েছে। গৃহিণী সেই বেড়া মেরামত করছেন। বর্ষা মৌসুম এলেই ভারী বর্ষণে পাহাড়ের লালচে মাটি নরম হয়ে পড়ে। দেখা দেয় ফাটল। টুপ করেই ধসে পড়ে মাটির বড় টুকরো। শুধু ওপরে গড়ে ওঠা টিনশেডের খুপরি ঘরের যে ক্ষতিই হয়, তা কিন্তু নয়। পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা বসতিঘরের মানুষেরাও মাটি চাপা পড়ার আতঙ্কে কাটান।
শহরতলির খাদিমপাড়া ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা আদর্শ গুচ্ছগ্রামের সরকারি দুটি টিলার ওপর আতঙ্ক মনে নিয়ে ঘুমুতে যায় ৮০টি পরিবার। দীর্ঘ প্রায় ২৭ বছর ধরেই এখানে পাহাড়ের ওপর ঝুঁকিপূর্ণ বসতি গড়েছেন তারা। কেউ কেউ এই সরকারি পাহাড়ে বসবাসের জমি বিক্রি
গতকাল বুধবার সরেজমিনে পাহাড় ঘুরে দেখা গেল, গুচ্ছগ্রামের টিলা কেটে বানানো রাস্তার এক পাশে ছোট-বড় দুটি পাহাড়। বৃষ্টির পানি পাহাড়ের লাল মাটির সবুজ গাছ বেয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে টপ টপ করে পড়ছে। মাটি ভেঙে পড়ার ক্ষত জড়িয়ে রয়েছে খাড়া পাহাড়ে।
নিচ থেকে অনেক উঁচুতে দেখা যাচ্ছে টিনশেডের একটি ঘর। ঘরের পাশেই পাহাড়ের টুকরো ভেঙে পড়ে অবশিষ্টাংশ ধসের অপেক্ষায় রয়েছে। এ অবস্থায়ও ওই ঘরের উঠোনে দুটি শিশু খেলা করছে। তারা ভাবলেশহীন। পাশেই শিশুদের মা আফিয়া বেগম গৃহস্থালী কাজ করছেন। আশপাশে পাহাড়ের ছড়িয়ে আছে আরও ঘরবাড়ি। কাটা টিলার ফাঁকে রয়েছে আরও কয়েকটি ঘর। এসব ঘরে যাবার কোনো রাস্তা নেই। পাহাড় কেটে পথ বানানো হয়েছিল। বৃষ্টির পানিতে লাল মাটি ধসে সেই পথও আর নেই। ধসে পড়া টিলার শরীর বেয়ে ঘরবাড়িতে লোকজন যাওয়া-আসা করেন।
আফিয়া বেগম জানালেন, তারা ১৫ বছর ধরে এই পাহাড়ে বসবাস করছেন। ঘরবাড়ি নেই। যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। স্বামী দিনমজুর। তিনি পরিবার নিয়ে এখানেই আশ্রয় বেঁধেছেন। গত রাত থেকে পাহাড় ধস হচ্ছে। ঘরের বেড়া ঠিক করছেন।
পাহাড়ি টিলার ফাঁকে আলিম উদ্দিনের পরিবার একটি খুপরি টিনের ঘর বানিয়ে বাস করেন। তার কন্যা বলেন , ‘ইকানো আমরা অনেক দিন ধরি থাকি। পয়লা ডর (ভয়) করত। এখন একটু কম ডর করে। রাতে ডর নিয়ে ঘুমাই।’
ঘুরে দেখা গেল, অন্তত ৫০ টি পরিবার পাহাড়ের ওপরে থাকেন। পাদদেশে বসবাস করে আরও প্রায় ৩০ টি পরিবার । ঘর বানানোর আগে কেউ কেউ পাহাড় কেটে রাস্তা বানাচ্ছেন। দুদিকে কাটা দুটি টিলা দেয়ালের মতো রয়েছে। এসব কাটা অংশের ফাঁক দিয়ে শিশুরা আসা-যাওয়া করে। আবার পাহাড়ের নিচেই ধসে পড়া মাটির স্তূপের পাশে পুরানো ও নতুন ঘরবাড়ি। ওপরের মতোই নিচের মানুষেরাও আতঙ্কে দিনযাপন করছেন।
টিলার পাদদেশের নিচের একটি ঘরের বাসিন্দ আম্বিয়া বেগম। তিনি জানান, কিছুদিন আগে টিলা ভেঙে তার ঘরের ওপরে পড়েছে। তবে ওই ঘরে কেউ থাকত না। শুধু ঘরের ক্ষতি হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ১৯৯২ সাল থেকে এখানে ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ে লোকজন বসবাস করে আসছেন। ওই সময়ে সিলেটের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার মুক্তিযোদ্ধারা গুচ্ছগ্রামের এই টিলার ২০০১ নম্বর দাগের ১২ একর এবং ২০১৫-১৬ নম্বর দাগের ২ একর জমি একশ বছরের জন্য বন্দোবস্ত নেন। শুরুর দিকে কয়েকজন ভূমিহীন মুক্তিযোদ্ধার পরিবার ওই পাহাড়ে ঘর বানিয়ে বসবাস করে। পরে তারা পাহাড়কে ভিটায় ভাগ করে বিক্রি করে চলে যান। বর্তমানে পাহাড়ে সকল পরিবারই শ্রমজীবী পরিবার। তারা পাঁচ হাজার টাকায় ওই পাহাড়েই বসবাসের জন্য স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে মৌখিকভাবেই জমি কিনে এসব খুপরি ঘর বানিয়ে বাস করে আসছেন।
স্থানীয় কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখানে অনেক দিন ধরেই ঝুঁকি নিয়ে প্রায় একশ পরিবার বসবাস করে আসছে। পাহাড়টি সরকারের খাসজমি। মুক্তিযোদ্ধাদের নামে বন্দোবস্ত হয়েছিল। কিন্তু তারা কেউ কেউ বিক্রি করে দিচ্ছেন। তাই নতুন নতুন পরিবার পাহাড়ে ঘর বানাচ্ছে। তাদের যাওয়ার জায়গা নেই; তাই তারা ঝুঁকি নিয়েও পাহাড়েই থাকতে চাচ্ছে। কয়েক বছর আগে সুরাই মিয়া নামের একজন পাহাড়ের মাটি ধসে আহত হয়েছিলেন। পরে তিনি মারা যান। এসব পরিবারের দাবি, পাহাড়টি কেটে সমতল করে তাদের বসবাসের সুযোগ করে দেওয়া হোক।
খাদিমপাড়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আনু মিয়া বলেন, মানুষের থাকার মতো জায়গা নেই। তাই তারা মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। সরকার এসব গৃহহীন পরিবারের জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে বলে আমরা আশাবাদী।
খাদিমপাড়া ইউনিয়নের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আফছর আহমদ বলেন, আমি নতুন নির্বাচিত হয়েছি। এখনো দায়িত্ব বুঝে নিইনি। এসব পরিবারের মানবিক বিষয় ও পরিবেশের বিপর্যয়ের বিষয়টি নিয়ে সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে যা করা দরকার করব।
সিলেট সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাসিম বলেন, এটা আমি জানতাম না। এখন যেহেতু জানলাম, খোঁজ নিয়ে অবশ্যই পরিবারগুলোর মানবিক দিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টি বিবেচনা করে ব্যবস্থা নেব।
পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের উপপরিচালক সালা উদ্দিন বলেন,টিলা-পাহাড় কাটা বন্ধে সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে আমরা প্রতিনিয়তই নোটিস দিচ্ছি। কোথাও পাহাড় কাটা বন্ধও করেছি। পাহাড়ে বসবাস ভিন্ন একটি বিষয়। খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেব। . . . . . . . . .