ফাইলে আগে সই করা নিয়ে বিরোধে কমিশনাররা

সিলেটের কন্ঠ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ এপ্রিল ২০১৬, ১১:৪১ পূর্বাহ্ণনির্বাচন পরিচালনায় সক্ষমতা ও আন্তরিকতা নিয়ে নির্বাচন কমিশন যখন নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত তখন সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটিতে শুরু হয়েছে অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। কমিশনারদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ নিয়ে শুরু হওয়া এ বিরোধ এখন ইসিতে মুখরোচক আলোচনার বিষয়।
গত উপজেলা, ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি করপোরেশন এবং সর্বশেষ দেশব্যাপী ইউনিয়ন পরিষদের প্রথম দুই ধাপের নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা, ভোট জালিয়াতি, কেন্দ্র দখল এবং সর্বোপরি প্রশাসনকে ব্যবহার করে নির্বাচনী ফলাফল পক্ষে নেয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ নিয়ে সুশিল সমাজের প্রতিনিধি ও বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কঠোর সমালোচনার মধ্যেই কমিশনারদের মধ্যে কে আগে ফাইলে সই করবেন তা নিয়ে দেখা দেয় জটিলতা।
২০১২ সালে এই কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে চার বছর ধরে যথাক্রমে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ, জাবেদ আলী, আবু হাফিজ এবং আবদুল মোবারক ক্রমানুসারে ফাইলে স্বাক্ষর করে আসছেন। অর্থাৎ ক্রমানুসারে উপরের দিকে স্বাক্ষর করার চল। সব শেষে ফাইলটি যায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের কাছে।
কিন্তু হঠাৎ করেই বিদ্যমান এ নিয়মে আপত্তি জানালেন নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ। তিনি দাবি করেন, সংবিধান অনুযায়ী সব নির্বাচন কমিশনার সমান পদমর্যাদার অধিকারী। অতএব এভাবে জ্যেষ্ঠতার ক্রম নির্ধারণ সঠিক নয়। ওই যুক্তিতে সপ্তাহান্তে ফাইলে স্বাক্ষরের ক্রম পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছেন তিনি।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, সম্প্রতি দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার একটি ইউনিয়নের নির্বাচনের অনিয়ম হয়। এ ঘটনায় শাহনেওয়াজ পুরো ইউপির ভোট স্থগিত করার ব্যাপারে মত দিয়ে নথিতে স্বাক্ষার করেন। এরপরে নথিটি নির্বাচন কমিশনার জাবেদ আলীর কাছে গেলে তিনি আটকে দেন। এ ঘটনাকে কেন্দ্রে করে নির্বাচন কমিশনার জাবেদ আলী ও মো. শাহনেওয়াজের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরম রূপ নেয়।
তবে ভোটের দিন মাঠ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পুরো ইউপি বন্ধের উপযুক্ত প্রতিবেদন না পাওয়ায় দুইটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত রাখা হয়।
চাঁদপুরের হাইমচরের এ ঘটনাকে কেন্দ্রে করে নির্বাচন কমিশনারদের কার আগে কে ফাইলে স্বাক্ষর করবে তা নিয়ে সমাধান চেয়ে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. সিরাজুল ইসলামের কাছে আন-অফিসিয়াল নোট (ইউও) দেন নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ। নোটের অনুলিপি নির্বাচন কমিশনারদের কাছেও পাঠানো হয়।
নোটে বলা হয়েছে, কোনো বিষয়ে নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে প্রথমে আমার স্বাক্ষর করার কারণে ভিন্ন সিদ্ধান্ত হলেও পরবর্তীতে আমাকে জানানো সম্ভব হয় না। নির্বাচন কমিশনাররা সম-মর্যাদার হওয়ায় প্রতি সপ্তাহে স্বাক্ষরের বিষয়টি সমপ্রক্রিয়ায় করা যতে পারে।
তিনি মনে করেন, একই আদেশে চার নির্বাচন কমিশনার ইসিতে যোগ দেয়ায় সবার সমান পদমর্যাদা। এক্ষেত্রে জুনিয়র-সিনিয়রের বিষয় থাকে না। সবার শেষে যোগ দেয়ায় কেন তাকে সবার আগে ফাইল অনুমোদনের জন্য স্বাক্ষর করতে হবে?

এদিকে এ জটিলতার কারণে রোববার সকালে সিইসির সঙ্গে নির্বাচন কমিশনারদের বৈঠকের পর বিকেল ৪টায় আরেক দফা বৈঠক হয়। যদিও বৈঠকে এর কোনো সুরাহা হয়নি বলে সূত্রে জানা যায়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ইসি সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম বাংলামেইলকে বলেন, এ ধরনের একটি ইউও নোট পেয়েছি। নির্বাচন কমিশন সার্বিক সিদ্ধান্ত নেন, ফাইল অনুমোদন করেন। এক্ষেত্রে রেওয়াজ অনুযায়ী ক্রমানুসারে তা মেনে চলা হয়। আমরা যেহেতু ফাইল উপস্থাপন করি, সেজন্যে বিষয়টিতে নজর দেওয়ার জন্যে নির্বাচন কমিশনার মহোদয় আমার বরাবর ইউও নোটটি দিয়েছেন। তবে সিদ্ধান্ত পেতে আমাকে সিইসির নজরে আনতেই হবে। তার মতামতেই পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক, আবু হাফিজ ও জাবেদ আলী ২০১২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি শপথ নিয়ে নির্বাচন কমিশনে যোগ দেন। পরবর্তীতে ১৫ ফেব্রুয়ারি শপথ নিয়ে যোগ দেন মো. শাহনেওয়াজ।
এতোদিন ধরেই ইসির যে কোনো সিদ্ধান্ত অনুমোদনে প্রথমে ফাইল যায় নির্বাচন কমিশনার শাহনেওয়াজের কাছে। পরে জাবেদ আলী ও আরো দুই নির্বাচন কমিশনার ঘুরে সিইসির কাছে তা পৌঁছে। এরপরেই সিদ্ধান্তটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে অনুমোদন দেয়া হয়।
ইসিতে একটি সিদ্ধান্ত অনুমোদনের ক্ষেত্রে চার কমিশনের মধ্যে তিন জনের সমর্থন থাকতে হয়। সমান সমান সমর্থন থাকলে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এক পক্ষে অবস্থান করতে হয়- কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এমনি রীতি চলে আসছে বলে ইসি সূত্রে জানা যায়।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, কাজী রকীব কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর চার বছরে মো. শাহনেওয়াজ সিনিয়রটি-জুনিয়রটি নিয়ে কোনো প্রশ্ন না তুললেও চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার একটি ইউপির বন্ধ করার সিদ্ধান্তটি অনুমোদন না হওয়ায় তিনি নাখোশ হয়েছেন। আর এ কারণে এত দিন পর কমিশনারদের সমমর্যাদার কথা বলছেন। তবে চাঁদপুর তার নিজের এলাকা হওয়ায় ব্যক্তিগত বিষয়টিও সামনে এসেছে বলে জানিয়েছেন একাধিক কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে সচিব বলেন, এখানে জুনিয়র-সিনিয়রের বিষয়টি এভাবে বিবেচিত হয় না। আমরা দেখেছি-সিইসির পরে ১, ২ নম্বর এভাবে ক্রম থাকে। বয়সের বিষয়টিও আমলে আনা যাবে না। বিধি ও প্রথা অনুযায়ী যিনি আগে শপথ নিয়েছেন তিনি সবার আগে ক্রমে থাকবেন।
তবে কমিশনার শাহনেওয়াজের অনুরোধের পর বিষয়টি পর্যালোচনা হতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, এক সপ্তাহ পর পর বাইরোটেশন ফাইল স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া নেওয়ার বিষয়টি সিইসি মহোদয়ের বিবেচনার ওপর নির্ভর করবে।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ বলেন, আমরা সবাই মিলে অধিকাংশ সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতভাবে নিই। মাঝে মাঝে যে কোনো বিষয়ে দুই রকম মতও আসে। এ ধরনের সাংবিধানিক সংস্থায় সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে এমন ভাগাভাগি হতেই পারে।
যেখানে নির্বাচন কমিশনের প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত কমিশনারদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতেই হয় তাহলে এই ক্রমতে কী সমস্যা আছে সেটি পরিষ্কার নয়। এটা কি মর্যাদার প্রশ্ন নাকি ব্যক্তিগত স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সে বিষয়ে জানতে কমিশনার শাহনেওয়াজের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া পরিবর্তন হলে ফাইল ব্যবস্থাপনা নিয়ে নতুন করে জটিলতা তৈরি হতে পারে বলে জানান ইসি কর্মকর্তারা।
তারা জানান, এমনিতেই যে কোনো ফাইল অনুমোদন করতে গিয়ে গলদঘর্ম অবস্থা হয় আমাদের। সর্বোচ্চ ৫ সদস্যের ইসি হওয়ায় তা নিয়ে বেশ জটিলতা হচ্ছে, কখনো কখনো বাসায়ও ছুটে যেতে হয় কর্মকর্তাদের। এখন নতুন করে কমিশনারদের ক্রম সপ্তাহে সপ্তাহে পরিবর্তন হলে ফাইল কার কাছে রয়েছে তা কতদিনে অনুমোদন হবে-তা নিয়ে জগাখিচুড়িতে পড়তে হবে।
. . . . . . . . .