বিদেশে সংগঠিত হচ্ছে আনসারুল্লাহ বাংলাটিম
সিলেটের কন্ঠ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ জানুয়ারি ২০১৬, ১১:২৯ পূর্বাহ্ণনিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে (এবিটি) সংগঠিত করছেন বিদেশে অবস্থানকারী কয়েকজন নেতা। পাকিস্তান, মালেশিয়া, যুক্তরাজ্য ও সিঙ্গাপুরসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে থেকে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাচ্ছেন এবিটি নেতারা। সশস্ত্র প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য তৎপরতা সমন্বয় করছেন পলাতক সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জিয়াউল হক। তার অবস্থান নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পাকিস্তানে অবস্থান করে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন দলের অন্যতম প্রধান ইজাজ হোসেন। মালেয়েশিয়ায় আছেন তেহজীব করিম, সেখানে অবস্থান করছেন দেশে ব্লগার হত্যা মামলার অন্যতম আসামি রেদোয়ানুল আজাদ রানাও। গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
সূত্রগুলো বলছে, এবিটির তাত্ত্বিক নেতা জসিম উদ্দিন রাহমানি গ্রেপ্তার হওয়ার আগে সশস্ত্র বিপ্লবের প্রস্তুতি নিয়েছিল জঙ্গি সংগঠনটি। তাদের কার্যক্রম জোরদার করতে রিসার্চ সেন্টার ফর ইউনিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আরসিইউডি) নামে একটি এনজিওর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে তারা উগ্রপন্থি সাংগঠনকি কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে এবিটির সিঙ্গাপুরসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাংগঠনিক কর্মী বাড়িয়ে কথিত জিহাদের নামে নাশকতার পরিকল্পনা করছে।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘এবিটি অনেক দিন ধরেই বিদেশে তাদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষ করে মালেয়েশিয়াতে সংগঠনটির পাঁচজন নেতা রয়েছে। এ ছাড়া পাকিস্তানেও তাদের এক নেতা রয়েছে। ওইসব নেতাদের ধরতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।’
এক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, ‘এবিটি মূলত আন্তজার্তিক জঙ্গি সংগঠন। যদিও বাংলাদেশে এই সংগঠনের কার্যক্রম ছড়িয়ে দিতে বিশেষ ভুমিকা রাখে সংগঠনটির তাত্ত্বিক নেতা মুফতি জসিম উদ্দিন রাহমানি। রাহমানি গ্রেপ্তার হওয়ার পর এই সংগঠনের নতুন নেতৃত্ব তৈরি হয়েছে। বিদেশে এবিটির কয়েক হাজার সদস্য রয়েছে। সম্প্রতি সিঙ্গাপুর পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া ১৪ জন এবিটি সদস্যকে রিমাণ্ডে নিয়েও এ ধরনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে।’
সূত্র জানায়, ‘বাংলাদেশে রিসার্চ সেন্টার ফর ইউনিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আরসিইউডি) নামে একটি এনজিওর আড়ালে এবিটির উগ্রপন্থীদের একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠেছে। পরবর্তীতে এটিই আনসারুল্লাহ বাংলাটিম নামে কার্যক্রম শুরু করে। আরসিইউডির কর্ণধার ছিলেন আব্দুর রশিদ। তিনি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। মালেয়েশিয়ায় অবস্থানরত এবিটির সংগঠক তেহজীব করিম তার জামাতা। তেহজীবের ভাই রাজীব করিমও এবিটির কর্মকাণ্ডে সসম্পৃক্ত। জঙ্গিবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে তিনি বর্তমানে ব্রিটেনের কারাগারে রয়েছেন। আরসিইউডি এনজিওর প্রধান আব্দুর রশিদ চৌধুরীর জামাতার মাধ্যমে বর্তমানে এবিটির জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনার তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্রমতে, ২০০২ সাল থেকে ধানমণ্ডির ৭ নম্বর সড়কের একটি বাসায় আরসিইউডি তাদের কার্যক্রম শুরু হয়। কয়েক বছর পর এটির কার্যালয় আজিমপুরে স্থানান্তর করা হয়। এরপর হাজারীবাগেও এনজিওটির কার্যালয় ছিল। ২০০৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এনজিওর আড়ালে জঙ্গি কার্যক্রম শুরু হয়। একই সময়ে তারা জামায়াতুল মুসলেমিন নামে জর্ডানভিত্তিক একটি জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রমের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে। তবে ২০০৯ সালের আগে ওই এনজিওর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। বয়োবৃদ্ধ আব্দুর রশিদ বর্তমানে ঢাকার গ্রিন রোডের একটি বাসায় থাকেন। তার জামাতা তেহজীব ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যার পর থেকে স্থায়ীভাবে মালেয়েশিয়া রয়েছেন। তিনি মূলত ইন্টারনেট ভিত্তিক এবিটির জঙ্গি ফোরামের নেতৃত্ব দেন। দেশে মুক্তমনা ব্লগারদের হত্যার নেপথ্যে রানার পাশাপাশি তারও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে বলে তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, এনজিওর কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার পর অনসারুল্লাহ ভিন্ন কৌশলে অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। বিশেষ করে সিঙ্গাপুরের একটি মসজিদে বয়ান ও বৈঠকে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জিহাদে উদ্বুদ্ধ করার নামে। তারা আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি এবিটিকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে কাজ করছিলেন। জসিম উদ্দিন রাহমানিকে গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানে অবস্থানরত ইজাজ হোসেনকেই এই সংগঠনের শীর্ষ নেতা বলা হয়। ২০০৪ সালে হরকাতুল জিহাদ (হুজি), আসিফ রেজা কমান্ডো ফোর্স, কাশ্মীরভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়েবা, জেএমজেবি, শাহাদৎ-ই-আল হিকমাসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আনসারুল্লাহ নেতাদের বৈঠক হয়।
এক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, আনসারুল্লাহর প্রধান হিসেবে মুফতি জসীমউদ্দীনকে ধরা হলেও জসিম মূলত সংগঠনের পাঁচজন শুরা সদস্যের একজন মাত্র। গোয়েন্দারা অন্য চার শুরা সদস্য সম্পর্কেও জানতে পেরেছেন। বর্তমানে আনসারুল্লাহর আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে ইজাজ হোসেন। তিনি পাকিস্তান থেকে একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। সেসময় ১৫ মিনিটের জন্য তিনি তাদের কলাবাগান প্রথম লেনের বাসায় যান। সেখানে চার ভাই ও মায়ের সঙ্গে কথা বলে তিনি ফের পাকিস্তানে চলে যান। তবে ইজাজ পাকিস্তান থেকে তাদের মায়ের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ রাখেন। ইজাজের স্ত্রী ও চার সন্তান এক সময় যাত্রাবাড়ীতে থাকতো।
ডিবি সূত্র জানায়, এবিটির মূল সংগঠন আনসার আল ইসলাম নামে বহির্বিশ্বে পরিচিত। আন্তজার্তিক এই সংগঠনটি বাংলাদেশে আনসারুল্লাহ বাংলাটিম নামে পরিচিত। সম্প্রতি ভিন্ন ভিন্ন নামেও এবিটির সদস্য কথিত জিহাদের নামে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংগঠনিক শক্তি বাড়াতে কাজ করছে।
প্রসঙ্গত, কৌশলগত কারণে বর্তমানে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সঙ্গে কাজ করছে আনসারুল্লাহ। ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে কুপিয়ে হত্যা করে এবিটি সদস্যরা। এর আগেই মুফতি জসীমউদ্দীন রাহমানি ৩১ সহযোগীসহ বরগুনায় গ্রেপ্তার হন। তবে গত বছর ব্লগার অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয় দাশ ও নীলাদ্রি চ্যাটার্জি নিলয় প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে হত্যা এবং আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলসহ তিনজনকে হত্যার চেষ্টা চালানোয় আলোচনা আসে এবিটি। এ ছাড়া গত এক বছরে এবিটির নামে দেশের শতাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে।
বাংলামেইল
. . . . . . . . .