রাজন হত্যা মামলার রায়ে আদালতের পর্যবেক্ষণে ছিল যা
সিলেটের কন্ঠ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১১ নভেম্বর ২০১৫, ১০:১৪ পূর্বাহ্ণআলোচিত শিশু সামিউল আলম রাজন হত্যা মামলার রায় গতকাল রবিবার প্রদান করেছেন সিলেট মহানগর হাকিম আদালত। আদালতের বিচারক আকবর হোসেন মৃধা মামলার পর্যবেক্ষণে রাজন হত্যাকান্ডকে ‘চরম নৃশংসতা, অমার্জনীয় বর্বরতা, চরম অমানবিকতা ও গ্লানিময় অবমাননাকর’ বলে উল্লেখ করেছেন।
আকবর হোসেন মৃধা পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছেন, ‘রাজনের মত হতভাগ্য, ভাগ্যবিড়ম্বিত, অসহায়, দরিদ্র শিশু কেবল চুরির মিথ্যা অপবাদে আটক হয়নি, নির্মম কায়দায় পিটিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে। মৃত্যুর আগে এক ফোঁটা পানি খেতে চাইলে তাকে তাও দেয়নি ঘাতকরা। ঘাতকদের এই আচরণ চরম নৃশংসতা, অমার্জনীয় বর্বরতা, চরম অমানবিকতা ও গ্লানিময় অবমাননাকর।’
পর্যবেক্ষণে তিনি আরো বলেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, এ মুহূর্ত থেকেই এ ধরণের অবমাননাকর আচরণ ও বর্বরতা বন্ধ হওয়া উচিত। সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদানই এ ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে পারে।’
৭৬ পৃষ্ঠার দীর্ঘ রায়ের পর্যালোচনায় বিচারক আকবর হোসেন মৃধা আরো উল্লেখ করেছেন, ‘জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে (সিআরসি) স্বাক্ষরকারী দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। এই সনদের অনুচ্ছেদ-৩ এ বলা হয়েছে, শিশুর সুরক্ষাই হবে যে কোন ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য। এই সনদে আরো বলা হয়েছে, কোন শিশুকে নির্যাতন করা যাবে না বা তার প্রতি নৃশংস, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ করা যাবে না। কোন শিশুই বেআইনীভাবে তার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হবে না। তাকে আটক করতে হলেও যথাযথ আইন মেনে চলতে হবে এবং তাকে মুক্ত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে।’
বিচারক তার পর্যবেক্ষণে আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ শিশু অধিকার অধ্যাদেশ-২০১৩ এ শিশুদেরকে বিশেষ অধিকার প্রদান করা হয়েছে। এই আইনে কোন শিশুকে গ্রেফতারকালে তার হাতে হাতকড়া পরানো বা তার কোমরে দঁড়ি বাধার নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এমনকি এই আইনের মাধ্যমে কোন শিশু অপরাধীর মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন সাজাও রহিত করা হয়েছে। এ সব জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে কোন শিশু অপরাধ করলেও তার সাথে অমানবিক, নির্মম বা অবমাননাকর আচরণে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।’
বিচারক আকবর হোসেন মৃধা উল্লেখ করেছেন, ‘এসব প্রচলিত আইন থাকা সত্বেও রাজনের মত হতভাগ্য, ভাগ্যবিড়ম্বিত, অসহায়, দরিদ্র শিশু কেবল চুরির মিথ্যা অপবাদে আটক হয়নি, নির্মম কায়দায় পিটিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে। তার সাথে যে আচরণ করা হয়েছে, তা অমানবিক এবং নির্মম। শিশু রাজন যখন মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে, যখন সে তার প্রাণ বাঁচাতে এক ফোঁটা পানি চেয়েছিল, তখন আসামী কামরুল, ময়না, পাবেল ও বাদল তার প্রতি চরম নির্মমতা, নৃশংসতা, বর্বরতা, অমানবিকতা ও অবমাননাকর আচরণ করেছে। এমনকি নির্মম প্রহারে সে যখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল, তখনও তাকে পিলারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছিল। পেছন থেকে হাত বেঁধে নির্মম ভাবে নিরপরাধ রাজনকে প্রহার করা, সে যখন পানির জন্য হাহাকার করছিল-তখন তাকে ঘাম খেতে বলা কিংবা যে শক্ত লাঠি দিয়ে তাকে আঘাত করা হচ্ছিল, সেই লাঠিটি ড্রেনের নোংরা পানিতে চুবিয়ে তার মুখে ঠেলে দেয়া- এমন আচরণ শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেও লাখো কোটি মানুষের মনে ঘাতকদের প্রতি ঘৃণা ও বিরাগের জন্ম দিয়েছে।’
‘কামরুল, ময়না, পাবেল ও বাদলের এমন আচরণ বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছে, যখন নির্মম এই হত্যাকান্ডের ভিডিও চিত্র তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ফেসবুক ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে গেছে। তাদের নির্মম ও অবমাননাকর আচরণ আমাদেরকে মধ্যযুগীয় বর্বরতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।’
পর্যবেক্ষণে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, ‘একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বর্বরতার দিকে ফিরে যেতে পারে না। পিলারের সাথে ঝুলিয়ে শিশু রাজনকে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে হত্যার ঘটনা ঘাতকদের প্রতি বিশ্বময় সর্বস্তরের মানুষের মনে ঘৃণার জন্ম দিয়েছে। এই পৃথিবীতে শিশু রাজনের বেঁচে থাকার অধিকার ছিল। তার প্রাণ কেড়ে নেয়ার কোন অধিকার নেই ঘাতকদের। এ কারণেই ঘাতক কামরুল, ময়না, পাবেল ও বাদলকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়েছে।’
. . . . . . . . .