অবসরে শমসের মবিন চৌধুরী: চাপে না ভয়ে?
সিলেটের কন্ঠ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ অক্টোবর ২০১৫, ১০:৫৮ পূর্বাহ্ণরাজনীতি থেকে বিএনপির ১৫ নম্বর ভাইস-চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী অবসরের ঘোষণায় বিস্ময় অবাক হয়েছেন দলটির সিলেট বিভাগীয় পর্যায়ের নেতারা। অবসরের কারণ হিসেবে তিনি নিজেই শারীরিক অসুস্থতার কথা বললেও আরও কিছু কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক সহকর্মীরা। তাদের মতে, পরিবারের চাপ ও বিগত কয়েক বছরে সিলেট জেলার রাজনীতিকদের অস্বাভাবিক পরিণতি এর অন্যতম কারণ। পাশাপাশি বিগত দিনে ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া, সাইফুর রহমানের সড়ক দুর্ঘটনা, শাহ এস এম কিবরিয়ার হত্যাকাণ্ড, বিএনপি নেতাদের গ্রেফতার ও গুমের ঘটনায় তিনি কিছুটা ভয় পেয়েছেন বলেও মনে করছেন ঘনিষ্টজনরা।এছাড়া, বর্তমান রাজনৈতিক ধারা ও আচরণকেও শমসের মবিনকে রাজনীতিবিমুখ করে তুলতে পারে বলে তারা মনে করছেন। বিষয়টি নিয়ে বৃহস্পতিবার বিএনপির সিলেট বিভাগীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে এমন তথ্য উঠে আসে।
সিলেট বিভাগীয় পর্যায়ের নেতারা মনে করছেন, শমসের মবিনের অবসরের ঘোষণা অনেকটা আকস্মিক। তবে, প্রত্যেকেই তার শারীরিক অসুস্থতার পাশাপাশি পরিবারের অনীহাকে সামনে আনছেন। যদিও শমসের মবিন চৌধুরী বলছেন, তিনি কোনও চাপে বা রাজনৈতিক চাপে পড়ে নয়, একান্ত শারীরিক অসুস্থতার কারণেই রাজনীতি ছেড়েছেন। তিনি অন্য কোনও দলেও যোগ দেবেন না। তবে তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আশা প্রকাশ করেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিগুলো এক হয়ে থাকুক।
সিলেট মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ডা. শাহরিয়ার হোসেন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গতকাল আমাদের ঈদ-পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান ছিল। ওই অনুষ্ঠানে তার আসার কথা ছিল। পরে তিনি জানান—তার শরীর অনেক অসুস্থ। তার জন্য আমরা যেন দোয়া করি। আমরাও তার আরোগ্য কামনা করি, দোয়া করি। কিন্তু হঠাৎ করেই আজ অবসর নেবেন, এটি তো ভাবিনি।
সিলেট বিএনপির অন্যতম এই নেতা আরও বলেন, এখনও পুরো পরিস্থিতি বোঝা মুশকিল। তিনি তার পদত্যাগপত্র ম্যাডামের কাছে মহাসচিবের মাধ্যমে পাঠিয়েছেন। ফলে, বলা কঠিন, তার পদত্যাগপত্র ম্যাডাম গ্রহণ করেন কি না। তবে এটি ঠিক যে, বিএনপি একটি বৃহৎ দল। সে হিসেবে একজন নেতার পদত্যাগের শূন্যতা পূরণে হয়তো আরও অনেকে কাজ করবেন। কিন্তু তিনি নিশ্চয় কিছু কাজে পারদর্শী ছিলেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, নবম খণ্ড-এর তথ্যমতে, ১৯৭১ সালে শমসের মবিন চৌধুরী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। তখন তার পদবি ছিল লেফটেন্যান্ট। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রতিরোধ যুদ্ধকালে চট্টগ্রামের কালুরঘাটের যুদ্ধে তিনি আহত হন। মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শমসের মবিন চৌধুরীকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তার বীরত্বভূষণ নম্বর ২১।
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, শমসের মবিন চৌধুরী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মেজর পদে কর্মরত থাকাকালে তার চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। পর্যায়ক্রমে পররাষ্ট্রসচিব পদে উন্নীত হন এবং পরে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে অবসর নেন। তার পৈতৃক বাড়ি সিলেট জেলায় এবং বাস করেন ঢাকায়। তার বাবার নাম আবদুল মবিন চৌধুরী, মা তাহমেদুন নাহার। স্ত্রী শাহেদা ইয়াসমিন। তাদের দুই ছেলে।
চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, শমসের মবিন চৌধুরী তো অসুস্থ। জেলে থাকাকালে অনেক বেশি অসুস্থ ছিলেন। এখনও সুস্থতা তার পিছু ছাড়েনি। এরপর চিকিৎসার স্বার্থে বিদেশে যেতেও দেওয়া হচ্ছে না। শরীর না কুলালে কিভাবে রাজনীতি করবেন তিনি।
সিলেট বিএনপির একজন দায়িত্বশীল নেতা জানান, শমসের মবিন আদ্যোপান্ত একজন ভদ্রলোক। খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল অনেক বেশি। বিএনপির পররাষ্ট্রবিষয়ক কাজগুলো তিনিই সম্পাদন করতেন। তবে, চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি তার বনানী ডিওএইচ এসের বাসা থেকে গ্রেফতার করার পর তার রাজনীতি নিয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে বড় আকারে প্রশ্ন তোলা হয়।
ওই নেতা জানান, তিনি কিছু দিন আগে শমসের মবিনের বাসায় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসেছেন। ওই সময় মবিন তাকে রাজনীতি থেকে দূরে থাকার কথা জানিয়েছেন। পরিবারের লোকজনও তার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে একমত ছিলেন না।
এই নেতার দাবি, এ বছর গ্রেফতারের সময় তার বাসার ছাদ ও পাশের বাসার ছাদ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়ে তাকে গ্রেফতার করে। যদিও কোনও সময় পলাতক ছিলেন না শমসের মবিন। এতে অভিজাত ওই এলাকায় প্রতিবেশী ও স্বজনদের কাছেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। এরপর চার মাস পর জেল থেকে এসে অসুস্থতা তাকে ছাড়েনি।
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইনাম আহমেদ চৌধুরীও তাই মনে করেন। তিনি বলেন, তিনি তো অসুস্থ। জেলে থাকাকালে অনেক বেশি অসুস্থ ছিলেন। এখনও তার পিছু ছাড়েনি। এরপর চিকিৎসার স্বার্থে বিদেশে যেতেও দেওয়া হচ্ছে না। শরীর না কুলালে কিভাবে রাজনীতি করবেন তিনি।
বিএনপির সিলেট বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবন জানান, শমসের মবিন চৌধুরীর স্ত্রী শাহেদা ইয়াসমিনও চাচ্ছিলেন, তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নিন। তার শরীর আসলেই অনেক দিন ধরে খারাপ যাচ্ছে।
তার রাজনীতি থেকে অবসরের কারণে সিলেট বিএনপিতে প্রভাব পড়বে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে সাখাওয়াৎ হাসান জীবন বলেন, পড়বে তো অবশ্যই। তিনি সিলেটের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ না করলেও তার পরামর্শ তো আমরা সবাই গ্রহণ করতাম। এ ক্ষেত্রে তার পরামর্শ তো এখন মিলবে না। এছাড়া, তিনি বিএনপির যে দায়িত্ব পালন করতেন, ওই বিষয়ে তো একটু গ্যাপ তৈরি হবে। তিনি সিলেট বিএনপি নিয়ে সুচিন্তা করতেন।
সিলেট জেলা বিএনপির একজন দায়িত্বশীল নেতার মতে, বিগত দিনে ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া, সাইফুর রহমানের সড়ক দুর্ঘটনা, শাহ এস এম কিবরিয়ার হত্যাকাণ্ড, বিএনপি নেতাদের গ্রেফতার ও গুমের ঘটনায় শমসের মবিন চৌধুরী মানসিকভাবে বেশি আহত হয়েছেন। তিনি অনেক আগে থেকেই ভয় পেয়েছেন।
তবে, একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সূত্র দাবি করেছে, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে দুরত্ব তৈরির কারণে বিএনপির বৈদেশিক কার্যক্রমে অনেকটা অচ্ছুত ছিলেন শমসের মবিন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময়ও তাকে রাখা হয়নি। এরপর একাধিকবার খালেদা জিয়া কূটনৈতিক কোরের অনেক কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেও ওই বৈঠকগুলোয় শমসের মবিন চৌধুরী অনুপস্থিত ছিলেন।
যদিও বিএনপি নেতা ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবন বলেন, এ সবের কোনও আশঙ্কা নেই। তিনি জেল থেকেই অসুস্থ। এরপর কোনও কর্মকাণ্ডে তিনি অংশগ্রহণ করেননি। ফলে, ম্যাডাম বা কারও সঙ্গে তার দূরত্বের কিছু নেই।
সিলেট জেলা বিএনপির একজন দায়িত্বশীল নেতার মতে, বিগত দিনে ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া, সাইফুর রহমানের সড়ক দুর্ঘটনা, শাহ এস এম কিবরিয়ার হত্যাকাণ্ড, বিএনপি নেতাদের গ্রেফতার, গুমের ঘটনায় শমসের মবিন চৌধুরী মানসিকভাবে বেশি আহত হয়েছেন। তিনি অনেক আগে থেকেই ভয় পেয়েছেন।
এসব ভয়ের বিষয়টি উড়িয়ে দিয়েছেন ইনাম আহমেদ চৌধুরী। তার মতে, কেন ভয় হবে। তিনি সামরিক বাহিনীতে ছিলেন। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন জাতীয়তাবাদী শক্তির সঙ্গে। শরীরের সঙ্গে তো পারা যায় না। এ কারণে তিনি অবসর নিয়েছেন।
এদিকে, অবসরে গেলেও জাতীয়তাবাদী শক্তির সঙ্গেই থাকবেন শমসের মবিন চৌধুরী—এমন আশা প্রকাশ করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। একই প্রত্যাশা উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদুর। তিনি মনে করেন, তার সঙ্গে আমার কথা হয়নি। তবে তিনি অসুস্থ থাকলে অবসর নিয়েছেন, এতে নেতিবাচক কিছু নেই।
শমসের মবিনের অবসরকে স্বাগত জানিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব উল আলম হানিফ বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে দলের এ অবস্থান ব্যক্ত করেন।
অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, আমি শুনেছি তিনি তার স্বাস্থ্যগত কারণে অবসর নিয়েছেন। তবে, এর বাইরেও কোনও সুনির্ধষ্ট কারণ আছে কি না, নিশ্চয় আগে-পরে আমরা জানতে পারব।
যাকে নিয়ে এত গুঞ্জন, সেই শমসের মবিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার দুপুরে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, রাজনৈতিক কিংবা পারিবারিক কোনও চাপ নয়, একান্তই শারীরিক অসুস্থতার কারণে আমি অবসর নিয়েছি। আমি মুক্তিযোদ্ধা। তাই প্রয়োজন হলেদেশ ও জনগণের সেবায় নিশ্চয় এগিয়ে আসব।
. . . . . . . . .