পঁচিশ বছর পর মায়ের সান্নিধ্যে ফজলু মিয়া
সিলেটের কন্ঠ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ অক্টোবর ২০১৫, ৩:০৯ অপরাহ্ণবয়সের ভারে ন্যুজ শরীর। হাটা-চলায় সাহায্য নিতে হয় অন্যের। শরীর শুকিয়ে হয়েছে হাড্ডিসার। কথা বলতেও মুখে জড়তা দেখা দেয়। নয়নের জল যেন শুকিয়ে গেছে অনেক আগেই।
এ অবস্থায় ২৫ বছর পর গর্ভধারিনী মায়ের সান্নিধ্য পাচ্ছেন ফজলু মিয়া। যেন সন্তানকে জীবন সায়াহ্নে একবার দেখে যাওয়ার জন্য খোদা তাকে বাচিয়ে রেখেছেন। ফজলুর জীবনের ২২টি বসন্ত কেটেছে কারাগারের অন্ধকার প্রকোস্টে। আর প্রিয় সন্তানের জন্য কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে গেছেন মা মজিরুন বেওয়া। আজ শনিবার মমতাময়ী মায়ের বুকে ঠাঁই নিবেন ফজলু মিয়া। শ্বাস নিবেন প্রাণ ভরে। সন্তান আর মায়ের এ যেন এক অবিস্বরণীয় দিন।
জীবনের সায়াহ্নে এসে যখন দেখা হচ্ছে, তখন ফজলু মিয়াও ষাটের কোটায়। আর তার মায়ের বয়স ৮০ পেরিয়ে।
শনিবার বিকেলে জামালপুর থেকে সিলেটে আসছেন ফজলু মিয়ার মা মজিরুন বেওয়া (৮০)। জামালপুরের জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে ফজলু মিয়ার মা-বোন ও আত্মীয়রা আসছেন তাকে নিয়ে যেতে।
এর আগে শুক্রবার বিকেলে সিলেটে ফজলুর কাছে পৌছেছেন তারই ছোট মামা মফিজ উদ্দিন ও চাচা মীর ফিরোজ আহমেদ। তাদেরকে কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরেন ফজলু। আর ভাগ্নেকে কাছে পেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন তারা দু’জনে।
বর্তমানে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার তেঁতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উছমান আলীর হেফাজতে ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্সে রয়েছেন ফজলু মিয়া।
শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টায় আলাপ হয় মফিজ উদ্দিনের। তিনি বলেন, আমরা জানতাম ফজলু মারা গেছে। কয়েকদিন আগে ঢাকা থেকে চাচাতো ভাই রাজু আহমেদ তাদের এ খবর দেন। ফজলু আমার চেয়ে দশ দিনের বড় এবং ফিরোজ ১৩ দিনের। জীবনের সায়াহ্নে হলেও প্রিয় মানুষকে বাকি জীবন কাছে রাখতে চান তারা। তবে যারা ফজুলর জীবনের এতোগুলো বছর নষ্ট করেছে, তাদের বিচার দাবি করেছেন মফিজ উদ্দিন।
আত্মীয়দের সঙ্গে মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার মনোভাসনা ব্যক্ত করে ফজলু মিয়া বলেন, ‘আমি আমার মায়ের কাছে যেতে চাই।
এক সময়ের তরুন টগবগে যুবক ফজলু এখন চলতে পারেন না আপন খেয়ালে। বিনা অপরাধে ২২ বছর সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি জীবন কাটিয়ে মুক্ত ফজলু মিয়া অবশেষে পেয়েছেন আপন ঠিকানা।
জামালপুর জেলার সদর উপজলার শাহবাজপুর সাউনিয়া গ্রামের মৃত বিষু মিয়ার ছেলে ফজলু মিয়া। শুক্রবার রাত ১২টায় জামালপুরের জেলা প্রশাসক শাহাব উদ্দিন খান তার গ্রামের বাড়িতে যান।
জেলা প্রশাসক শাহাব উদ্দিন খানের মুঠোফোনে কথা হয় ফজলু মিয়ার ছোট বোন হামিদা বেগমের।
তিনি বলেন, ‘আমার ভাই বেচে আছেন জানতাম না। তাকে দেখার অধীর আগ্রহে আছি। মা মজিরুন, নানা হাসমত উল্লাহ, মামা আবদুল হালিম ও খালুকে নিয়ে বৃহস্পতিবার সিলেটে আসছেন বলে জানান তিনি।
জামালপুরের জেলা প্রশাসক শাহাব উদ্দিন খান শুক্রবার রাতে মুঠোফোনে বলেন, ফজলুর প্রকৃত পরিচয় নিশ্চিত করতে পরিবারের সদস্যদের ডাকা হয়েছিল। সিলেটে অবস্থানরত ফজলুর সঙ্গে তাদের মোবাইল ফোনে কথাও হয়েছে। এখন ফজলুকে তাঁর পরিবারের কাছে ফিরিয়ে আনতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
ফজলুর পরিবারের বরাত দিয়ে জেলা প্রশাসক আরও জানান, ১৯৮৪ সালে কিশোর বয়সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন ফজলু। এরপর ১৯৮৭ সালে একবার সিলেটে আশ্রিত পালক পিতা মওলা মিয়াকে নিয়ে বাড়িতে যান। সর্বশেষ ১৯৯১ সালে বাড়িতে বেড়িয়ে আসেন। এরপর তার আত্মীয় স্বজনরা ফজলুর কোনো খবর পাননি।
সিলেটে ফজলুর বাল্যবন্ধু কামাল উদ্দিন রাসেল বলেন, জেলা প্রবেশন অফিসার তমিজ উদ্দিনের মাধ্যমে ফজলু কারাগারে রয়েছে জানতে পারেন। এরপর লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ব্লাস্ট’র সহায়তায় তাকে আদালতের মাধ্যমে ছাড়িয়ে আনেন।
তিনি আরও বলেন,’৯৩ সালে এক পুলিশ সার্জেন্ট তাকে আটক করে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠান এবং পরবর্তীতে পাগল আইনের ১৩ ধারায় আদালতে প্রসিকিউশন দেন জনৈক ওই পুলিশ সার্জেন্ট। ফজলুর বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই।
স্বজনরা জানায়, ফজলু মিয়ার বাবা বিষু মিয়া ৭৬ সালে মারা যান। ভিটেমাটিহীন ফজলুর মা থাকেন ভাইদের আশ্রয়ে। আর একমাত্র বোন হামিদা বেগম ঝিয়ের কাজ করে জীবন-যাপন করেন। তার নানা মৌলভি হাসমত উল্লাহ, মামা আব্দুল হালিম, আব্দুল গনি, আব্দুর রেজ্জাক, আব্দুস ছাত্তার ও মফিজ উদ্দিন জীবিত আছেন।
৩১ বছর আগে রাগ করে বাড়ি থেকে চলে আসার পর ফজলুর আশ্রয় জুটেছিল সিলেটের দক্ষিণ সুরমার গোলাম মাওলা নামের এক ব্যক্তির কাছে। তাঁকে নিয়ে বছর তিনেক পর একবার শাউনিয়া গ্রাম ঘুরে যাওয়ার পর ফজলুর সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি কারো।
একমাত্র সন্তানের সন্ধান না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়েছেন মজিরন বেওয়া । সম্প্রতি গণমাধ্যমের সংবাদে ফজলুর স্বজনরা জানতে পেরেছে তাঁর জেলমুক্তির কথা। কিন্তু পরিচয়ের ‘সঠিকতা’ যাচাইয়ের সুযোগ হচ্ছিল না। অবশেষে গত বুধবার জামালপুরের জেলা প্রশাসক শাহাবুদ্দিন খান এ বিষয়ে উদ্যোগী হন।
তিনি নিজ বাসায় ডেকে পাঠান ফজলুর পরিবারের সদস্য ও স্বজন দাবিদারদের। তিনি বৃহস্পতিবার সকালে সিলেটে অবস্থানরত ফজলু মিয়ার সঙ্গে তাদের ফোনে কথা বলার সুযোগ করে দেন। নানা-মামাসহ আত্মীয়রা কথা বলে নিশ্চিত হন।
২২ বছরের বন্দি জীবনের পর স্বজনের সন্ধান না পেয়ে আদালত সিলেটের সুরমা থানার তেতুলী ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার কামাল উদ্দিন রাসেলের হেফাজতে ফজলু মিয়াকে হস্তান্তর করেন।
বর্তমানে সেখানেই অবস্থান করছেন ফজলু। দীর্ঘ কারাবাসে তিনি মানসিক ভারসাম্য অনেকটাই হারিয়েছেন। তবে স্বজনদের চিনতে পারায় এখন স্বস্তিতে আছেন সবাই।
জীবনের শেষবেলায় মায়ের কাছেও পৌঁছেছে সন্তানের বেঁচে থাকার সংবাদ। দৃষ্টিহীন মজিরন নাড়ি ছেড়া ধন আদরের সন্তানকে দেখতে না পেলেও একবার হাত বুলিয়ে দেখতে চান। শুনতে চান মা ডাক। এরই অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন মা জননী। আর শনিবার মা-ছেলের মিলন ঘটছে।
. . . . . . . . .