রাজন হত্যা : কামরুল এখন সিলেটে তবে অধরা থাকবে শামীম-পাভেল!
সিলেটের কন্ঠ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ অক্টোবর ২০১৫, ১০:২৩ অপরাহ্ণবহুল আলোচিত শিশু শেখ সামিউল আলম রাজন হত্যার প্রধান আসামি কামরুল ইসলামকে নিয়ে সৌদি থেকে ফিরেছে পুলিশ। কিন্তু চার মাসেও এই মামলায় আসামি শামীম ও পাভেলের কোনো হাদিশ মিলেনি। তারা দেশে আছে না কামরুলের মত বিদেশে পালিয়ে গেছে তাও নিশ্চিত করতে পারছে না পুলিশ। এমন অবস্থায় প্রশ্ন ওঠেছে, এই দু’জন কি তবে পলাতকই থাকবে? নাকি কামরুলকে ফিরিয়ে এনে পুলিশ যে কৃতিত্ব দেখিয়েছে, পলাতক ওই দু’জনকেও গ্রেফতার করে সেটাকে আরও উজ্জ্বল করবে?
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, রাজন হত্যার পর প্রথমে গ্রেফতার করা হয় কামরুলের ভাই মুহিত আলমকে। এরপর একে একে গ্রেফতার হয় আরও ১১ জন। ৮ জুলাই ঘটনার পর দুপুরে লাশ গুম করতে গিয়ে স্থানীয়রা ধাওয়া করে আটক করেন মুহিতকে। তাঁদের দাবি একই সময় তারা সৌদি প্রবাসী কামরুল ইসলামকে ধাওয়া দেন। কিন্তু পরে সে জালালাবাদ থানা পুলিশকে ছয় লাখ টাকায় ‘ম্যানেজ’ করে সৌদি আরবে পালিয়ে যায়। এমন দাবি রাজনের বাবা শেখ আজিজুর আলমেরও। এই ঘটনায় কামরুলসহ অভিযুক্তদের নামে মামলা করতে গেলে জালালাবাদ ধানা পুলিশ তার সাথে দুর্ব্যবহার করে। এমন অভিযোগে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার রোকন উদ্দিনকে প্রধান করে ১৪ জুলাই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
২৪ জুলাই বর্ধিত সময়ে ৪২৪ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন দাখিল করে কমিটি। তদন্তে টাকা গ্রহণের বিষয়টি প্রমাণিত হয়নি বলে দাবি করা হয়। তবে দায়িত্বে অবহেলার কারণে ওই থানার ওসি (তদন্ত) আলমগীর হোসেন, মামলার বাদী এসআই আমিনুল ইসলাম, এসআই জাকির হোসেনকে বরখাস্ত করা হয়। আলমগীরকে ২৭ জুলাই ও দুই এসআইকে ২৪ জুলাই জালালাবাদ থানা থেকে বরখাস্ত করা হয়।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ৮ জুলাই ধাওয়া খাওয়ার পর রাতেই সিলেট ছাড়েন কামরুল। এরপর ৯ জুলাই ঢাকা থেকে সৌদির উদ্দেশে বিমানে ওঠে তিনি। ১০ জুলাই সেখানে পৌছে আত্মগোপন করেন। এরমধ্যে রাজন হত্যার নির্মম ভিডিও চিত্রে তোলপাড় সবখানে। রাজনকে পৈশাচিক কায়দায় নির্যাতনকারী কামরুল সৌদিতে পালিয়ে গেছে এমন খবরে ক্ষোভ বাড়ে সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে। ১৩ জুলাই তাঁরা তাঁকে খুঁজে বের করে আটক করেন। এরপর তাঁকে সৌদি পুলিশের হেফাজতে দেওয়া হয়। সৌদিতে আটকের পর কামরুলকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার করার দাবি জোরালো হয়। কিন্তু সৌদির সাথে বন্দিবিনিময় চুক্তি না থাকায় বিষয়টি জটিল হয়ে পড়ে। এমন প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক পুলিশি সংস্থা ইন্টারপোলের স্মরণাপন্ন হয় বাংলাদেশ পুলিশ। ইন্টারপোল ২১ জুলাই কামরুলের বিরুদ্ধে নোটিশ জারি করে। এরমধ্যে কামরুলকে ফিরিয়ে দিতে রাজন হত্যা মামলার বিভিন্ন কাগজপত্রসহ ৩২ পৃষ্ঠার একটি ফাইল সৌদি সরকারের কাছে পাঠায় বাংলাদেশ। কামরুলকে ফিরিয়ে দিতে সৌদি রাজকীয় আদালতও নির্দেশ জারি করেন। একই সঙ্গে তাঁকে ফিরি আনতে জোর নিরবিচ্ছিন্ন তৎপরতা অব্যাহত রাখে পুলিশ। এমন প্রেক্ষাপটে তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সহজ প্রক্রিয়া খুঁজছিল সৌদি। ওয়ার্কপারমিট বিষয়টি সমাধান করে দেয়।
১৮ অক্টোবর কামরুলের ওয়ার্কপারমিটের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। মেয়াদ নবায়ন না করে তাঁকে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় পুলিশ। এই প্রক্রিয়ায় ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাকে দেশে আনতে ১২ অক্টোবর রাতে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে সৌদির উদ্দেশে যাত্রা করেন পুলিশের তিন কর্মকর্তা। ওইদিন ভোরে তারা দেশটিতে পৌঁছেন।
তদন্ত শেষে ঘটনার এক মাস আটদিন পর ১৬ আগস্ট সিলেট মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ইন্সপেক্টর সুরঞ্জিত তালুকদার মেট্রোপলিট ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৩ জনের বিরুদ্ধে ‘চার্জশিট’ (অভিযোগপত্র) দাখিল করেন। এরমধ্যে কামরুল ইসলাম, শামীম আহমদ ও পাভেলকে পলাতক দেখানো হয়। ২৪ আগস্ট আদালত চার্জশিট গ্রহণ করে পলাতকদের গ্রেফতারে পরোয়ানা ও তাদের মালামাল বাজেয়াপ্তের নির্দেশ জারি করেন। ২৫ আগস্ট কামরুল ইসলাম ও শামীম আহমদের মালামাল বাজেয়াপ্ত করে জালালাবাদ থানা পুলিশ। পরে পাভেলের দিরাইর বাড়িতে অভিযান হলেও বাজেয়াপ্ত করার মত তার কোনো মালামাল পাওয়া যায়নি। এই তিনজনকে পলাতক দেখিয়ে ৩১ আগস্ট আদালতের নির্দেশে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।
রাজন হত্যা মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে নিয়ে বিচারের দাবি ওঠেছিল। এমন দাবির প্রেক্ষিতে ২২ জুলাই রাজনের বাড়িতে এসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসদুজ্জামান খান কামাল ও ২০ আগস্ট আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তাঁর কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন রাজন হত্যার বিচার ‘দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে’ হবে। কিন্তু সেটি হয়নি। মামলাটি মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে ৭ সেপ্টেম্বর মহানগর দায়রা জজ আদালতে স্থানান্তর হয়।
২২ আগস্ট সিলেট মহানগর জজ আদালত ১৩ জনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচারকাজ শুরু করেন। এতে বিচারক, সংশ্লিষ্ট পুলিশ, ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক, রাজনের বাবা-মা, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীসহ ৩৮ জনকে সাক্ষী করা হয়। তিনজনকে পলাতক রেখেই ১ অক্টোবর শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ। এরপর ৪, ৭, ৮, ১১, ১২, ১৩, ১৪ ও ১৫ অক্টোবর এই নয় দিবসে ৩৫ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। আগামী ১৮ অক্টোবার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিলেট মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ইন্সপেক্টর সুরঞ্জিত তালুকদারের সাক্ষ্য নেওয়া হবে।
এই মামলায় চার্জশিটভূক্ত আসামিরা হলেন, সিলেট সদর উপজেলার জালালাবাদ থানার কুমারগাঁও এলাকার শেখপাড়া গ্রামের মৃত আব্দুল মালেকের ছেলে ও কামরুলের ভাই মেঝো ভাই মুহিত আলম (৩২), বড় ভাই আলী হায়দার ওরফে আলী (৩৪), ছোট ভাই শামীম আলম (২০), সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ঘাগটিয়া গ্রামের অলিউর রহমান ওরফে অলিউল্লাহর ছেলে মো. জাকির হোসেন পাভেল ওরফে রাজু (১৮), জালালাবাদ থানার পীরপুর গ্রামের মৃত মব উল্লাহর ছেলে সাদিক আহমদ ময়না ওরফে বড় ময়না (৪৫), পূর্ব জাঙ্গাইল গ্রামের মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিনের ছেলে ভিডিওচিত্র ধারণকারী নূর আহমদ ওরফে নুর মিয়া (২০), শেখপাড়া গ্রামের মৃত আলাউদ্দিন আহমদের ছেলে দুলাল আহমদ (৩০), সুনামগঞ্জের দোয়ারা উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের জাহাঙ্গীরগাঁওয়ের মোস্তফা আলী ওরফে পেচার ছেলে আয়াজ আলী (৪৫), শেখপাড়া গ্রামের সুলতান মিয়ার ছেলে তাজউদ্দিন আহমদ ওরফে বাদল (২৮), সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার দোলারবাজার ইউনিয়নের দক্ষিণ কুর্শি ইসলামপুর গ্রামের মৃত মজিদ উল্লাহর ছেলে মো. ফিরোজ আলী (৫০), কুমারগাঁওয়ের (মোল্লাবাড়ি) মৃত সেলিম উল্লাহর ছেলে মো. আজমত উল্লাহ (৪২) ও হায়দরপুর গ্রামের মৃত সাহাব উদ্দিনের ছেলে রুহুল আমিন রুহেল (২৫)। তাজ উদ্দিন বাদল ও রুহুল আমিন ছাড়া বাকি ৮ জন রাজন হত্যা মামলায় আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। হত্যাকা-ের পর মুহিত আলমের স্ত্রী লিপি বেগম ও শ্যালক ইসমাইল হোসেন আবলুছকে গ্রেফতার করা হলেও অপরাধে জড়িত থাকার প্রমাণ না পাওয়ায় তাদের অভিযোগপত্র থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
পলাতক দুই আসামির ব্যাপারে সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনার কামরুল আহসান জানান, রাজন হত্যার সব আসামিকে আইনের আওতায় আনতে পুলিশ আন্তরিকভাবে কাজ করছে। সৌদি থেকে কামরুলকেও ফিরিয়ে আনা হয়েছে। খোঁজা হচ্ছে পলাতক শামীম ও পাভেলকে। তাদেরও গ্রেফতার করা যাবে বলে তিনি আশাবাদী। তবে তারা দেশেই আছে না দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তারা দেশ ছেড়ে বলে এমন কিছু শুনিনি। . . . . . . . . .