সৎমায়ের সংসারে নির্যাতনেই ঘর ছেড়েছি, আর বাসায় ফিরবোনা
সিলেটের কন্ঠ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ অক্টোবর ২০১৫, ১১:০০ পূর্বাহ্ণতখন রাত সাড়ে ন’টা। সিলেট কোতোয়ালি থানায় উৎসুক সাংবাদিকের ভিড়। পুলিশের সহকারী কমিশনার, ওসি, এস আই সহ সবার চোখেমুখে তখন তৃপ্তির ছাপ। কেউ ভিড় সামলাতে ব্যস্ত; কেউ রিসিভ করছেন ফোনের পর ফোন। কিছুক্ষন আগেই উদ্ধার করা হয়েছে হারিয়ে যাওয়া তিন ভাইবোন আছিয়া(১২), সাদিয়া(৪) ও ইরহামকে(৩)।
অনেক উদ্বেগ উৎকন্ঠা শেষে সু্স্থ অবস্থাতেই খুঁজে পাওয়া গেছে তাদেরকে। আর তাতেই অনেকটা স্বস্তিতে উদ্ধারকারী দল। অবশ্য কোনো আপহরনকারীর খপ্পড়ে পরতে হয়নি শিশুদের।
বুধবার বিকেলে ঘর ছাড়ে তারা, উদ্দেশ্য ঢাকা পালানো। তারপর একটা কিছুতো হবেই। সিলেটের কাজলশাহ এলাকার ৪৩,এ নম্বর বাসা থেকে বেড়িয়ে সোজা সিলেট রেল স্টেশনে। তারপর ট্রেনধরে ঢাকায়। ট্রেনেই পরিচয় এক আংকেলের সাথে। কামরুল ইসলাম শিশুদের সাথে কাউকে না দেখে তাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন।
প্রথমে কয়েকদিন ঢাকায় নিজের বাসায় রাখলেন তিনি। এরপর শিশুদের বুঝিয়ে সিলেটে তাদের বাসায় ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুতেই মানাতে পারেননি। অগত্যা কামরুল ইসলাম সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজর এলাকায় তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসলেন।
পরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তার শিশুদের সিলেট কোতোয়ালী থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেন তিনি। এরপর থেকেই পুলিশের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখা হয় তাদের।
অবশ্য এরইমধ্যে শিশুদের বাবা দুলাল আহমেদ থানায় জিডি করে রেখেছিলেন। খবর প্রকাশ হয়েছিলো বেশকিছু গণমাধ্যমেও।
মংগলবার রাতে থানায় নিয়ে আসার পর ভীষন ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো তাদের। সাদিয়া আর ইরামতো রীতিমতো চেয়ারে পড়ে ঘুমাচ্ছে। কিছুটা অস্থির দেখাচ্ছিলো ১২ বছরের আছিয়াকে। কাজলশাহ রাধারানী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেনীতে পড়ে সে।
কোথায় যাচ্ছিলে? জিজ্ঞেস রতেই বললো, “জানিনা, তবে প্রথমে ঢাকা যাচ্ছিলাম”।
কেন কাউকে কিছু না বলে পালাতে চাইলে? উত্তরে আছিয়া প্রথমে অনেকটা চুপ থাকলো। মুখ দেখে বোঝা গেলো ছোট্ট শিশুটার বুকের ভেতরে চাপা কষ্ট রেরিয়ে আসছে। তবু কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো “খুব কষ্টে ছিলম। প্রায়ই বকা দিতো, মারধর করতো”। সৎমায়ের সংসারে বসবাস। এম্নিতেই অনেক অভাব অনটন। তার উপর বাবার পিটুনি, সৎমায়ের ভর্তসনা জুটতো শিশুদের ভাগ্যে।
এখন কোথায় যাবে? উত্তরে আছিয়া বললো, “জানিনা”। জানতে চাইলাম, বাবাতো তোমাকে নিতে এসছেন? তখন ঝটপট বলে দিলো “সেখানে আর যাবোনা”। “কেনো”? অনেকবার জিজ্ঞেস করেও এ ব্যাপারে আর কোনো কথা বেরুয়নি তার মুখ থেকে।
পরে কথা হলো উপপরিদর্শক মো. মাসুদের সাথে। তিনি দোয়ারাবাজার থেকে তাদের থানায় নিয়ে এসছেন। ঐসময়টুকু দেখভালে তিনি ছিলেন। নিজের সন্তানের মতোই শিশুদের ছিলো তার আবেগী প্রকাশ।
মাসুদ জানালেন, বাবার সংসারে অত্যাচার আর মানসিক চাপে শিশুরা অনেকটাই ভেংগে পড়েছে। তবে, আপাতত: তাদের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখা হবে। তাদের কোনো কষ্টই হবেনা বলেও আশ্বাস দিলেন তিনি।
ঢাকা জেলার লৌহজং থানাধীন বিক্রমপুর গ্রামের বাসিন্দা, প্রাণ আরএফএল গ্রুপের কর্মচারী দুলাল আহমেদ সিলেটের কাজলশাহ এলাাকায় বাস করছেন দশ বছর ধরে। জানা গেলো আছিয়ার বাবা দুলাল তিনটি বিয়ে করেছেন। প্রথম স্ত্রীর ঔরসজাত আছিয়া। জন্মের আটমাস পর আছিয়ার মা স্বামী ও মেয়েকে ছেড়ে চলে যান। পরে আরেকটি বিয়ে করে আছিয়ার বাবা। স্ত্রীর ঔরসে জন্ম নেয় সাদিয়া ও ইরহাম। কিছুদিন পর দ্বিতীয় স্ত্রী ও চলে যায় ভাগ্যের অন্বেশনে। এরপর তৃতীয়দফায় বছরখানেক আগে সেলিনা বেগমকে বিয়ে করেন দুলাল আহমেদ। তিন শিশু সৎমায়ের সংসারেই থাকতো।
উদ্ধারের খবরে মংগলবার রাতেই খবর পেয়ে থানায় ছুটে আসেন শিশুদের বাবা ও তার স্বজনেরা। দুলাল আহমেদ জানান, মেয়েকে একটু আধটু শাসন করতেন। বাবা হিসেবে মেয়েকে শাসন করার অধিকার আছে। বাধ্য হয়েই একাধিক সংসার করতে হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিশুদের জন্যই আমি বারবার সংসার করছি। সবকিছুর পরেও সন্তানদের বাসায় ফিরিয়ে নিতে চাইছেন তিনি।
“শিশুরা যেহেতু বাবার কাছে যেতে চাইছেনা, সেহেতু সবদিক বিবেচনা করেই ব্যাবস্থা নেয়া হবে। তবে আপাতত পুলিশের তত্বাবধানে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখা হচ্ছে তাদের”, জানালেন কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সোহেল আহাম্মদ।
. . . . . . . . .