চা শ্রমিকদের ধর্মঘট কেন?
ইয়াহিয়া নয়ন
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ আগস্ট ২০২২, ৭:৫২ অপরাহ্ণ৩০০ টাকা দৈনিক মজুরির দাবিতে চা-শ্রমিক ইউনিয়নের ডাকে ৯ আগস্ট থেকে সারাদেশের ২৪১টি চা বাগানের দুই লাখ শ্রমিক কর্মবিরতি পালন করছে। গণমাধ্যমে প্রতিদিন তাদের ধর্মঘটের খবর ছবি প্রকাশিত হচ্ছে। চা শ্রমিকদের বর্তমান মজুরি ১২০ টাকা। অথচ দেশে বর্তমানে একজন কৃষি শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ৬০০ টাকা। ভাবতে অবাক লাগে। দুই লাখ নারী পুরুষ চা শ্রমিক পরিবার পরিজন নিয়ে কিভাবে নি কাটাচ্ছে। কাল টেলিভিশনে দেখলাম ধর্মঘটরত একজন নারী শ্রমিক প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাচ্ছেন। সব আবেদন কেন শুধু তাঁর কাছেই করতে হবে। জনগণের পয়সায় যারা ফুটানি করে বেড়াচ্ছেন,তাদের কি কোনো দায় নেই?
শ্রমিক কল্যাণমুখী বাংলাদেশের চা শিল্প যখন বিশ্ববাজারে প্রভাব বিস্তার করছে, তখন শ্রমিকদের আন্দোলনে নামতে বাধ্য করে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বাজারকে ঝুঁকিতে ফেলা হচ্ছে কার স্বার্থে? এ প্রশ্ন আজ দেশের সচেতন নাগরিকদের। প্রতিনিয়ত নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে। অথচ বাংলাদেশের চা শ্রমিককরা ১২০ টাকা মজুরিতে কাজ করছেন। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে শ্রমিকরে সংগঠন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চা সংসদ নেতৃবৃন্দের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ সময় শ্রমিকদের মজুরি বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু চুক্তির ১৯ মাস অতিবাহিত হলেও সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করেনি মালিক পক্ষ। তাই তারা আন্দোলনে নেমেছেন। কেন চুক্তির বাস্তবায়ন করা হয়নি?
বঙ্গবন্ধু চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে এবং পরে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে চা-শিল্পের উন্নয়নে অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন। চা-শিল্পে বঙ্গবন্ধুর অসামান্য অবদান ও চা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে তার যোগদানের তারিখকে স্মরণীয় করে রাখতে এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে চা-শিল্পের ভূমিকা বিবেচনায় ৪ জুনকে ‘জাতীয় চা দিবস’ ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশ চা বোর্ডের উদ্যোগে ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, চা-শিল্পের প্রসার’ স্লোগান নিয়ে গত ৪ জুন ২০২১ তারিখে বর্ণাঢ্য আয়োজনে দেশের সব চা উৎপাদনকারী অঞ্চলে উদযাপিত হয় ১ম জাতীয় চা দিবস।
বঙ্গবন্ধু চা বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালীন মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকায় সরকার কর্তৃক বরাদ্দকৃত ০.৩৭১২ একর ভূমির ওপর চা বোর্ডের প্রধান কার্যালয় নির্মাণকাজ ত্বরান্বিত হয়। তিনি ১৯৫৭ সালে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে টি-রিসার্চ স্টেশনের গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করে উচ্চফলনশীল জাতের ক্লোন চাগাছ উদ্ভাবনের নির্দেশনা প্রদান করেন। চায়ের উচ্চফলন নিশ্চিত করতে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এবং শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা বাগানে উচ্চফলনশীল জাতের চারা রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। তিনি ‘টি অ্যাক্ট-১৯৫০’ সংশোধনের মাধ্যমে চা বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ড চালু করেছিলেন, যা এখনো চালু রয়েছে।
সম্পূর্ণ বস্তুনিষ্ঠ গবেষণাভিত্তিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী চা-শ্রমিকদের প্রাপ্ত আবাসনসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নিয়েও একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, দেশের অন্য যে-কোনো খাতের তুলনায় চা শ্রমিকদের মজুরি সর্বনিম্ন ও বৈষম্যমূলক। অথচ সার্বিক বিবেচনায় এ খাতটি অর্থনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া, এখন পর্যন্ত কোনো পরিসংখ্যান বা তথ্য-উপাত্ত দিয়েও কেউ বলতে পারেননি যে, চা-বাগানের মালিক পক্ষ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা এমন কোনো অবস্থায় আছেন যে, যাদের অবদানের ওপর নির্ভর করে চা-শিল্প বিকাশমান, সেই শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি প্রদানে তারা অক্ষম। বরং এটি একটি লাভজনক বাণিজ্যিক খাত। অন্যদিকে চা-শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরিসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার ায়িত্ব শুধু মালিকপক্ষের মর্জির ওপর ছেড়ে য়ো ঠিক নয়। চা-শ্রমিকদের দেশের নাগরিক হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে তাদের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে চলমান আইনসম্মত আন্দোলনের যৌক্তিকতা অনুধাবনের পাশাপাশি সমতাভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে চা-শ্রমিকদের নিকট গ্রহণযোগ্য যৌক্তিক মজুরি নির্ধারণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
চলমান সমস্যার সমাধানে বাগান মালিকদের ঔপনিবেশিক মানসিকতা পরিহার করতে হবে ও সরকারকে চা-শ্রমিকদের দেশের নাগরিক হিসেবে গণ্য করে, ন্যায্য ও মানবিক উদ্যোগ নিতে হবে। একইসাথে, চা বাগান শ্রমিকদের ক্ষেত্রে শ্রম আইনের কার্যকর বাস্তবায়নের পাশাপাশি দেশের অন্যান্য সমপর্যায়ের খাতের সর্বনিম্ন মজুরি বিবেচনায় নিয়ে জীবন ধারণের উপযুক্ত ও চা-শ্রমিকদের নিকট গ্রহণযোগ্য যৌক্তিক পারিশ্রমিক নির্ধারণে বাগান মালিক, চা সংসদ ও সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি শেবাসীর।
সরকারকেও খুঁজে দেখতে হবে কেন ১৯ মাসেও প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করেনি মালিক পক্ষ। আমলারা মালিক পক্ষের ালালি করছে বলে আ›োলনকারীদের অভিযোগ। এসব তদন্তের বিষয়। এখন সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে,সমস্যার সমাধান করা। এরই মধ্যে বাগানগুলোর চা পাতা এবং কারখানার অনেক পাতা নস্ট হয়ে গেছে। গরীব শ্রমিকরা পরিবার নিয়ে অসহায় অবস্থায় রয়েছে। তারা এখনও পর্যন্ত তাদের াবি নিয়ে শান্তিপূর্ণ আ›োলন চালিয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের উচিত শ্রমিকদের পাশে দাড়ানো। রিদ্র চা শ্রমিকদের সাথে আর কতো তামাশা করবেন আপনারা?
লেখক : সাংবাদিক।






