সিনেমা হলই যদি না থাকে তাহলে দর্শকরা সিনেমা দেখবে কোথায়।

সিলেটের কন্ঠ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ নভেম্বর ২০২০, ৮:৪১ অপরাহ্ণ
হাবিবুল ইসলাম হাবিব
সিনেমার সবচাইতে বড় দুঃসময় চলছে, সিনেমা বা চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত সবাই এটা স্বীকার করবেন। তাহলে কি চলচ্চিত্র শিল্প ইতিহাস হয়ে থাকবে অদূর ভবিষ্যতে। এই প্রশ্নটাই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
করোনা মহামারি এসে এই প্রশ্নটাকে আরও বাস্তব করে তুলছে। মানব সভ্যতার ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কোনও মহামারি বা দুর্যোগ মানব সভ্যতাকে থামিয়ে দিতে পারেনি। করোনা দুর্যোগকেও মানুষ জয় করবে, এটাই সত্য চিরন্তন। করোনা থিতু হলে সিনেমা কি রমরমিয়ে চলবে? কীভাবে চলবে, যেখানে নব্বই দশকের শুরুতে বাংলাদেশে সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল এক হাজার চারশ’ পঁয়ত্রিশটি। দুই দশকে কমতে কমতে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে একশ’র কাছাকাছি (মাঝেমধ্যে নানান উৎসব উপলক্ষে হাটে বাজারে, কালেভদ্রে ৪০-৫০টি ভাঙাচোরা অস্বাস্থ্যসম্মত সিনেমা হল যুক্ত হয়ে থাকে)। গত দুই দশকে বাংলাদেশের কোথাও নতুন সিনেমা হল নির্মাণ হয়নি। সিনেমা হলই যদি না থাকে তাহলে দর্শকরা সিনেমা দেখবে কোথায়। হাটে মাঠে ময়দানে নিশ্চয় সিনেমা দেখানো হবে না। সিনেমা বা চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নে বাণিজ্যিক দৃষ্টিতে সিনেমা হলের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তা নিয়েই আলোচনা।
১৮৯৫ সালে লুমিয়ের ব্রাদার্স সর্বপ্রথম সিনেমা ধারণাটিকে দর্শকদের সামনে নিয়ে আসেন। সিনেমার সূচনার সেই তারিখটি ছিল ২৮ ডিসেম্বর। এই ঘটনার পরপরই মাত্র এক দশকের মধ্যেই সিনেমা তার অভিনবত্ব কাটিয়ে উঠে এক বিশাল সার্বজনীন বিনোদন শিল্পে পরিণত হয়। নির্বাক থেকে সবাক, সাদা কালো থেকে রঙিন সিনেমা- পাড়ি দিয়েছে অনেকটা পথ। সিনেমার এই পথ চলায় অবিভক্ত ইংরেজ শাসিত ভারতও খুব একটা পিছিয়ে থাকেনি। সিনেমার যাত্রা শুরুর পরের বছর ভারতের দর্শকরা সিনেমার সঙ্গে পরিচিতি লাভ করে। ১৮৯৬ সালে তৎকালীন বোম্বে শহরের ওয়াটসন হোটেলের বিরাট হল ঘরে লুমিয়ের ভাইদের সিনেমা ‘দ্য অ্যারাইভাল অব আ ট্রেন অ্যাট দ্য স্টেশন’ প্রদর্শিত হয়। অবশ্য দর্শকদের অধিকাংশ ছিলেন শাসক ইংরেজ কর্তা আর মুষ্টিমেয় অভিজাত ভারতীয়। ১৮৯৮ সালে কলকাতা পা রাখে সিনেমা দর্শনে। জে স্টিভেনসন এক ইংরেজ স্টার থিয়েটারে প্রদর্শিত করেন নির্বাক সিনেমা। এরপর সারা বিশ্বের এগিয়ে থাকা দেশগুলো নেমে পড়ে সিনেমা নির্মাণে।
অবশ্য এর পেছনে প্রেরণা হিসেবে ছিল বাণিজ্যিক মুনাফা অর্জন। বিশাল দর্শকদের মুগ্ধ হয়ে এই অভিনবত্ব ভোগ করার আগ্রহ সিনেমাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। পরাধীন ভারতবাসী এই নতুন প্রযুক্তিকে আত্মস্থ করতে লেগে পড়ে। ঢাকার সন্তান হীরালাল সেন ভাই মতিলাল সেনকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি। এই কোম্পানি তখনকার মঞ্চায়িত নাটকের দৃশ্য, নানা রকম ঘটনাবলি ইত্যাদি নিয়ে প্রায় চল্লিশটির মতো সিনেমা তৈরি করে ফেলেন। যদিও তিনি ভারতে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা তৈরির কৃতিত্ব পাননি। ১৯০৩ সালে তাদের কাহিনিভিত্তিক সিনেমা ‘আলিবাবা অ্যান্ড ফর্টি থিভস’ দর্শকদের মনোরঞ্জনে প্রদর্শিত হয়। তার আগে ১৮৯৯ সালে বোম্বেতে সখারাম ভাতওয়াদেকর নামের এক ভারতীয় স্বল্পদৈর্ঘ্যের দুটি ছবি ‘দ্য রেসলারস’ ও ‘ম্যান অ্যান্ড মাংকি’ নির্মাণ করেন। সিনেমা বলতে যে ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত সে ধারণায় প্রথম নির্বাক সিনেমা তৈরি হয় ধুনধীরাজ গোবিন্দ ফালকের পরিচালনায় ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’। ছবিটির দৈর্ঘ্য ছিল তিন হাজার সাতশ’ ফিট। ১৯১৩ সালে এর মধ্য দিয়ে ভারতীয় সিনেমা শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। বোম্বের পর কলকাতায় সিনেমা তৈরি শুরু হয় ১৯১৭ সালে। প্রথম বাংলা নির্বাক সিনেমা ‘সত্যবাদী রাজা হরিশ্চন্দ্র’। সিনেমাটি নির্মাণে এগিয়ে এসেছিল প্রদর্শক ম্যাডানের এলফিনস্টন বায়োস্কোপ কোম্পানি। ওদিকে ভারতে পাঞ্জাবের কেন্দ্র লাহোরে গড়ে ওঠে আরেকটি সিনেমা কেন্দ্র। আব্দুর রশিদ কারদার ১৯৩০ সালে নির্মাণ করেন নির্বাক ছবি ‘হুসনে কি ডাকু’। তিনটি কেন্দ্র- বোম্বে যাকে বলা হয় বলিউড, কলকাতা যাকে টালিউড নামেই সবাই চেনে, আর লাহোর কেন্দ্রিক সিনেমাকে বলা হতো ললিউড। ততদিনে ভারতীয় জনগণের এক বিনোদনের জায়গা নিয়ে নিয়েছে সিনেমা। সারা ভারতেই তৈরি হতে লাগলো একের পর এক সিনেমা হল। তৎকালীন পূর্ব বাংলা সিনেমার কেন্দ্র হিসেবে যাত্রা শুরু না করলেও সিনেমা হল নির্মাণে পিছিয়ে থাকেনি। বোম্বে, কলকাতা, লাহোর ও বিশেষ হলে বিদেশি ইংরেজি সিনেমাই দেখানো হতে লাগলো।
১৮৯৮ সালে পাটুয়াটুলী এলাকায় ক্রাউন থিয়েটারে প্রথম সিনেমা প্রদর্শিত হয়। প্রথাগত সিনেমা হল নির্মিত হয় ১৯১৫ সালে। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল চলছে। লেজার নামের এক ইংরেজ নবাব ইউসুফ খান থেকে জায়গা কিনে আরমানিটোলায় সিনেমা হলটি তৈরি করেন, নাম দেন পিকচার হাউজ। লেজার সেটি পরে বিক্রি করে দেন উদ্ভবজী ঠাকুর নামের এক মারোয়ারি ব্যবসায়ীর কাছে। পিকচার হাউজ অনেকটা পরে নাম বদলে হয় শাবিস্তান। একুশ শতকের শুরুতেই হলটি বন্ধ হয়ে যায়। সারা দেশে ব্যবসাটির প্রসার ঘটে, দেশব্যাপী গড়ে ওঠে একের পর এক সিনেমা হল।
দেশ ভাগ হয়ে আমরা যখন পূর্ব পাকিস্তান, তখন আমাদের নিজেদের সিনেমা বানানোর ভাবনা এলো অনেকের মাথায়। কল্পনাকে বাস্তব করতে এগিয়ে এলেন আব্দুল জব্বার খান। ফরিদপুরে সংগঠিত এক ডাকাতির কাহিনি নিয়ে তিনি নেমে পড়লেন এই বাংলার প্রথম সিনেমা বানাতে। ১৯৫৩ সালে শুরু করে ১৯৫৬ সালে মুক্তি পেলো এই বাংলার প্রথম সিনেমা ‘মুখ ও মুখোশ’। সিনেমাটি দর্শকদের মধ্যে বিপুল আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল। চৌষট্টি হাজার রুপি ব্যয় হয়েছিল সিনেমাটি নির্মাণে। প্রথম দফাতেই ছবিটি আয় করে ৪৮ হাজার রুপি। সিনেমা আর থেমে থাকেনি এই বাংলায়। পঁয়ষট্টির যুদ্ধের পর ভারতীয় সিনেমা নিষিদ্ধ হলে লাহোর করাচির সিনেমার সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিয়ে এগিয়েছে এই বাংলার সিনেমা। আজ সেই সিনেমার কী দুর্দশা। বাংলাদেশের বহু জেলায় এই সময়ে কোনও সিনেমা হল নেই। ভাবা যায়!
পর্যটন নগরী কক্সবাজারে বিনোদনের জন্য তেমন কোনও সিনেমা হল নেই। আগে এই শহরে দুটি সিনেমা হল ছিল। পর্যটনের অপর শহর রাঙামাটির অবস্থাও তাই। আগে এই শহরে তিনটি সিনেমা হল ছিল। ঢাকার পাশে নরসিংদী শহরে ছিল তিনটি সিনেমা হল, এখন একটিও চালু নেই। একই অবস্থা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরেও, সেখানে তিনটি সিনেমা হলের সবকটিই বন্ধ। সিনেমা হল নেই নড়াইল, ঝালকাঠি, পঞ্চগড়, মুন্সীগঞ্জ জেলা শহরেও। একের পর এক বন্ধ হয়ে সেখানে গড়ে উঠছে বহুতল ভবন মার্কেট। এজন্যই চলচ্চিত্র শিল্পকে বাঁচাতে নতুন ভাবনায় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। বলা হয় মানসম্পন্ন সিনেমা না থাকাতে সিনেমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে দর্শকরা, তাই এই ধস। মানসম্পন্ন সিনেমা তৈরি হবার সুযোগইতো কমে গেছে। সিনেমা হল নেই, যাও আছে তারও সংস্কার নেই। প্রথাগত সিনেমা হলের সংজ্ঞা বদলে গেছে, সিনেমা দেখার প্রচলিত ধারণাও বদলে গিয়ে আজ অন্য রূপ নিয়েছে। সিনেমা দেখা, কেনাকাটা, খাওয়া দাওয়া ইত্যাদি মিলিয়ে প্যাকেজ বিনোদনের সময় এখন। সেজন্যই সিনেপ্লেক্স গড়ে তুলতে সচেষ্ট হতে হবে। দর্শকদের ফিরিয়ে আনতে হবে সিনেমা দেখার জন্য।
নব্বই দশক পর্যন্ত সিনেমা দেখাটা ছিল পারিবারিক বিনোদনের অন্যতম উৎস। অবস্থাটা বদলে যেতে থাকে আকাশ সংস্কৃতির উদ্ভব হওয়ায়। এর আগে টেলিভিশনে চ্যানেল বলতে একটিই ছিল। সেটি ছিল বিটিভি। আকাশ সংস্কৃতি নাগরিক জীবনে বহু চ্যানেল দেখার জানালা খুলে দিলো, তাও দিবস ও রজনী চব্বিশ ঘণ্টা। তার মধ্যে আবার বিদেশি চ্যানেল। নিষিদ্ধ বস্তুর আকর্ষণের মতো সনাতন ধারা নাগরিকদের হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখা গেলো টেলিভিশন পর্দায়। তাতে আরও জোগান দিলো বাংলা সিনেমার অধোগতি। সে সময় বহু নির্মাতাকে বলতে দেখা গেছে তাদের নির্মিত সিনেমা নিম্নবিত্তরা দেখলেই তারা টিকে যাবে। সেজন্যই হয়তো অশ্লীলতা গ্রাস করতে লাগলো বাংলা সিনেমাকে। মেধা ও মননের চর্চার এই পতন মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করলো বিপুল সংখ্যার মধ্যবিত্তকে। তারা বিনোদনের উৎস হিসেবে আঁকড়ে ধরলো চার দেয়ালি বিনোদনের বাহন টিভিকে। দর্শক কমতে থাকায় লোকসানের বোঝা টানতে টানতে প্রথাগত সিনেমা হলগুলোর ঝাঁপ বন্ধ হতে লাগলো। যারা নিভু নিভু হলেও টিকে থাকলো, তারা সংস্কার দর্শকদের সুবিধার কথা বিবেচনায় নিতে পারলো না। সিনেমা দেখার পরিবেশ পৌঁছালো তলানিতে।
তাহলে কি আকাশ সংস্কৃতির বিকাশ সিনেমার এই দুর্দশার জন্য দায়ী? এই প্রশ্নে বিতর্ক চলতে পারে, অনেকেই এই প্রশ্নে সমর্থন জানাতে পারে। তবে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বিচার করা হলে দেখা যাবে আকাশ সংস্কৃতির বিকাশ সিনেমাকে হটাতে পারেনি বরং আকাশ সংস্কৃতি সহায়ক হয়েছে সিনেমার বাণিজ্যিক বিকাশে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে দৃষ্টি ফেললে দেখতে পাবো সেদেশে জাতীয় তথা বলিউডি সিনেমার রমরমা অবস্থা। এমনকি আঞ্চলিক সিনেমাও পুঁজি ফেরত পেয়ে মুনাফা করছে। সেদেশে সিনেমার হিট বিচার হচ্ছে প্রথম সপ্তাহে সেল শত কোটির বিচারে। সেদেশে আকাশ সংস্কৃতির বিকাশে রয়েছে তিনটি মাধ্যম। ক্যাবল টিভি, ডিটিএইচ ও আইপি টিভি। রয়েছে আঞ্চলিক, জাতীয়, আন্তর্জাতিক মিলিয়ে সহস্র টিভি চ্যানেল। সেখানে সিনেমার রমরমা বাজার। এর প্রধান কারণ সেদেশে সিনেপ্লেক্সের বিস্তার ঘটেছে জনমানসের মানসিকতাকে লালন করে। সেদেশেও প্রথাগত সিনেমা হল বন্ধ হচ্ছে, এর মধ্যে ঐতিহ্যধারী বহু সিনেমা হলও রয়েছে। সিনেমার নির্মাণ কৌশল, বিষয়ও বদলেছে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে।
লস্ট ফাউন্ড, অ্যাকশন আর মধুর মিলন- এই ফর্মুলা সিনেমা এখন হয় না। সেখানে বায়োপিক এমনকি মঙ্গল অভিযান নিয়ে সিনেমার বিষয় হয়। সেগুলো দর্শকদের আনুকূল্যও লাভ করে। আমরাও এখানে প্রথার বাইরে গিয়ে টান টান চিত্রনাট্যে সিনেমা নির্মাণ করি, কিন্তু দর্শকরা দেখবে কোথায়। বহু জেলা শহরে সিনেমা হলের অস্তিত্বই নেই। যা কটি আছে সেসব হলে না আছে আরামদায়ক আসন ব্যবস্থা, না আছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ, না আছে আধুনিক শব্দ ব্যবস্থা, পরিবেশ তো কহতব্য নয়। মানসম্পন্ন সিনেমা তৈরি হবে কী করে। কোনও প্রযোজক লোকসান দেওয়ার জন্য অর্থ লগ্নি করবেন না, এ কারণেই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধারণা বদলাতে হবে। জেলায়, উপজেলায় গড়ে তুলতে হবে সিনেপ্লেক্স। তাহলেই বাঁচবে বাংলা সিনেমা, তৈরি হবে মানসম্পন্ন দর্শক। বিনিয়োগ ফেরত পাবার গ্যারান্টি এই ধারণার সঙ্গে জড়িত। সিনেপ্লেক্স বিষয়টি কী? এবার আলো ফেলা যাক সিনেপ্লেক্স ধারণাটির দিকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সিনেমা দেখার রুচি ও ধ্যান ধারণার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। শুধু সিনেমা দেখার জন্যই দল বেঁধে যাওয়া এরকমটা আজকাল হয় না। সিনেমা দেখার সঙ্গে শপিং করা, খাওয়া দাওয়া জড়িয়ে আছে। ধরুন একটি পরিবার হয়তো চারজনের, তাদের সঙ্গে একই ছাদের তলায় বসবাস না হলেও কাজিনদের যোগাযোগ তো আছেই। তারা সবাই এক হয়ে লম্বা সময় কাটাবে। অনলাইনে সিনেপ্লেক্সগুলোতে কী ছবি চলে তা দেখে পছন্দ করা হলো সিনেমা। অনলাইনেই টিকিট বুকিংয়ের পর দল বেঁধে সিনেমা দেখতে যাওয়া। একটু আগে বের হল দুয়েকজনের কেনাকাটা আছে। দল বেঁধে শপিং এরপর সিনেপ্লেক্সে সিনেমা দেখা, এর পরই বাড়ি ফেরা নয়। সেই সিনেপ্লেক্সের একই ছাদের তলে নানান ভ্যারাইটির রেস্তোরাঁর একটিতে দল বেঁধে খাওয়া দাওয়া। লম্বা একটা সময় কাটিয়ে বাড়ি ফেরা। এই হলো সিনেপ্লেক্স সংস্কৃতি।
ভাঙা চেয়ার, ছারপোকার কামড়, গুমোট পরিবেশে গুদাম ঘরে বসে কি সিনেমা দেখা সম্ভব? যেখানে ঘামতে ঘামতে পুরো একটা সিনেমা দেখাতো যুদ্ধ জয়ের শামিল। আপনি যুদ্ধে যাচ্ছেন না, যাচ্ছেন গাঁটের পয়সা খরচ করে একটু বিনোদন পাওয়ার আশায়। তার ওপর প্রজেকশনের যে অবস্থা, পর্দাটা যেন সাদা কালোর প্রতিভূ। শব্দের অবস্থা তো আরও ভয়াবহ। সংলাপ আপনার কান পর্যন্ত পৌঁছবে কিনা সে সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। এই অবস্থায় একজন সুস্থ মানুষ সিনেমা দেখতে গিয়ে অসুস্থ হবার সিদ্ধান্ত কেন নেবেন?
দর্শনীয় সব লোকেশনে চিত্রায়িত গান, বিদেশে করা পোস্ট প্রোডাকশন, যত্ন নিয়ে করা শব্দের কাজ, স্পেশাল ইফেক্ট সবই মাটি হয়ে যাবে প্রথাগত যে সিনেমা হলগুলো টিকে আছে, সেগুলোতে সিনেমা দেখতে গেলে। আপনি তো একা সিনেমা দেখতে যাচ্ছেন না, ভাই বোন কিংবা বান্ধবী, প্রেমিকা রয়েছে সঙ্গে। প্রথমেই নিরাপত্তার শঙ্কা, টয়লেটের অবস্থা তো গোয়াল ঘরের চাইতেও জঘন্য। এর সব কিছুর বিপরীত হচ্ছে সিনেপ্লেক্স। সিনেপ্লেক্সের টিকিটের চড়া মূল্য নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলবেন। পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা দিয়ে মূল্য যদি নেয় তাহলে সেটাতো ধর্তব্যের মধ্যে আসে না। ঢাকা শহরে সিনেপ্লেক্সের সংখ্যা সাকুল্যে দশটির বেশি নয়। সিনেপ্লেক্সের সংখ্যা যখন বাড়বে তখন প্রতিযোগিতা চলবে। দর্শক ধরে রাখতে টিকিটের মূল্যও কিছুটা কমবে। টিকিট সহজলভ্য করে দর্শক টানাটাও একটি বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। ঢাকার বাইরে আর কোথাও সিনেপ্লেক্স গড়ে উঠেছে বলে জানা নাই। হয়তো বন্দর নগরী চট্টগ্রামে একটি দুটি গড়ে উঠেছে। তাহলে এত মানুষ কোথায় সিনেমা দেখবে।
হল মালিকরা সিনেপ্লেক্স ধারণাটি বাস্তবায়ন করতে পারবে না, তাদের কাছে বিনিয়োগ করার মতো অর্থ নেই। এখানেই সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। বাস্তবমুখী পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সিনেপ্লেক্স গড়ায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। অনেকেই স্বীকার করছেন সিনেপ্লেক্স ছাড়া চলচ্চিত্র ব্যবসা ধরে রাখা যাবে না। বর্তমানে এটা উচ্চাভিলাষ নয়, এটি এখন বাস্তবতা। অনেক আগেই চলচ্চিত্রের উন্নয়নে এই বাস্তবতাটি বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেওয়ার দরকার ছিল, তাহলে বাংলা সিনেমার এমন ধস নামতো না। অতি দ্রুত সিনেপ্লেক্স বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিতে হবে। যুগ ও প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি, তাই আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের বেহাল দশা। এবার কল্পনায় দৃশ্য আঁকি কেমন হবে তিনশ’ সংসদীয় আসনে তিনশ’ সিনেপ্লেক্স।
যেহেতু সিনেপ্লেক্স একের ভেতর বহু, তাই সিনেপ্লেক্স হবে শপিং কমপ্লেক্স। বহুতল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শপিং কমপ্লেক্সের টপ ফ্লোরে হবে মাল্টিপ্লেক্স। আলাদা আলাদা সিনেমা প্রদর্শিত হবে, যাতে দর্শকদের পছন্দকে প্রাধান্য দেওয়া যায়। মাল্টিপ্লেক্সে থাকবে প্রশস্ত লাউঞ্জ, সেখানে সাজানো থাকবে আরামদায়ক সোফা। এমনভাবে সাজানো হবে, বহু মানুষের ভিড়ে ভারাক্রান্ত মনে যেন না হয়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে ফুডকোর্ট, যেখানে নানা রকম খাবারের সমাবেশ থাকবে। মানে হলো, এসব মাল্টিপ্লেক্স পরিকল্পনাহীন যাচ্ছেতাইভাবে গড়ে তোলা যাবে না। পৌরসভাগুলো এই কমপ্লেক্স গড়ে তোলায় কোনও আপস করবে না, পরিকল্পনার এক তিলও অদলবদল করা যাবে না। এই বিশাল কর্মযজ্ঞে অর্থের জোগান দেবে কে, সরকার? না। সরকার পরিকল্পনা অনুমোদন দেবে, ঋণের ব্যবস্থা করবে এবং প্রয়োজনে জমি দেবে। ব্যবস্থাপনা হবে বেসরকারি।
ভাবা যেতে পারে পিপিপি পাবলিক প্রাইভেট প্রজেক্ট হিসেবেও। যদি সূচনা ঘটানো যায় তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় নাগরিকদের জন্য এই কমপ্লেক্স হবে একটি জনপ্রিয় ডেস্টিনেশন। জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নও প্রতিটি গ্রাম হবে শহর, গ্রামীণ অবকাঠামো থাকবে, নাগরিকদের নাগালের মধ্যে থাকবে সকল আধুনিক নাগরিক সুবিধা। তিনশ’ সংসদীয় আসনে তিনশ’ সিনেপ্লেক্স উল্লিখিত ভাবনা বাস্তবায়নকে ত্বরান্বিত করবে। সিনেকমপ্লেক্স তৈরি হলে সেখানে কি বিদেশি সিনেমা দেখানো হবে? বিদেশি আমদানি নির্ভর সিনেমার পৃষ্ঠপোষকতার জন্য এই আন্দোলন নয়। দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্পকে বাঁচাতে, জগৎসভায় আসন নিতে এই সিনেপ্লেক্স ভাবনা।
এবার বাংলা সিনেমা কেমন হবে সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। অবশ্যই বাংলা সিনেমা বাংলা সংস্কৃতি, বাঙালিয়ানা নিয়েই আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে হবে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক হয়ে উঠতে হবে।
কাঙ্ক্ষিত সিনেপ্লেক্স সারাদেশে গড়ে উঠলে সেসব সিনেপ্লেক্সে কি বিদেশি সিনেমা জাঁকিয়ে বসবে? এই আশঙ্কা অনেকেই করেন হালফিলে বাংলা সিনেমার অবস্থা দেখে। আশঙ্কাটি অমূলক নয়। সিনেপ্লেক্সে যারা বিনিয়োগ করবেন তারা নিশ্চয় লোকসানের বোঝা বইবেন না। দর্শক শূন্য সিনেপ্লেক্স উদ্যোক্তারা চাইবেন না। এখানে সচেতন হতে হবে চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িতদের। মেধাবী মননশীল নির্মাতাদের সুযোগ করে দিতে হবে প্রযোজকদের। শিল্পীদের বেলায় একই কথা। সম্পূর্ণ পেশাদারদের স্বাছন্দ্যে বিচরণের সুযোগ করে দিতে হবে। তাহলেই বাংলা সিনেমা আবার ঘুরে দাঁড়াবে। গল্পে, নির্মাণে, চিত্রনাট্য, সংগীত সকল বিভাগে মেধাবীদের মিলন ঘটলেই সেই সিনেমাটি হয়ে উঠবে দর্শক নন্দিত সিনেমা। কারিগরি প্রযুক্তির দিকেও নজর দিতে হবে। আধুনিক সর্বশেষ প্রযুক্তি আমদানি, প্রশিক্ষণ আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সেন্সর বোর্ডকেও আধুনিক সংস্কৃতিমনা নীতি দিয়ে সিনেমার ছাড়পত্র প্রদানকে বিচারে আনতে হবে। সর্বোপরি সরকারের প্রশাসনের হস্তক্ষেপ মুক্ত হতে হবে। সমাজের নানা অসঙ্গতি সিনেমার গল্পে উঠে আসাটা স্বাভাবিক। অপরাধীরা নিজেদের শাসক দলের লেবেল লাগায় অপরাধকে জায়েজ করতে। নানাভাবে ম্যানেজ করার প্রতিভাবান তারা। সিনেমায় এসব চিত্র উঠে আসলে রাজনৈতিক দলগুলো সিনেমাটির বিপক্ষে অবস্থান নিতে পারে। এখানেই সরকার নিরেপেক্ষ অবস্থানে থেকে গণতান্ত্রিক চর্চাকে উৎসাহিত করলে সিনেমার যেমন লাভ তেমনি সমাজ নির্মাণে রাখবে ভূমিকা।
তাই বলে অশ্লীলতা, নগ্নতাকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে। বাঙালিয়ানা নগ্নতা অশ্লীলতাকে স্বীকার করে না। বাংলা সিনেমা আধুনিক হবে, সর্বশেষ প্রযুক্তি সমৃদ্ধ হবে কিন্তু বাঙালিয়ানার মূল চরিত্র ধরে রেখে। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে আছে বাঙালিরা, সেই বাজারটিকে ধরতে হবে। তাহলেই বাংলা সিনেমার নতুন দিনের শুরু হবে, বিশ্বব্যাপী বাজবে বাংলা সিনেমার জয় ডংকা। টেলিভিশন, অনলাইন বাংলা সিনেমার জন্য হুমকি মনে করেন অনেকেই। অনেকে ভাবেন সিনেমা হয়ে যাবে অ্যাপস নির্ভর। অ্যামাজন, নেটফ্লিক্স, হইচই, বায়োস্কোপ এসব হবে সিনেমার প্ল্যাটফর্ম। সিনেমার চরিত্র এই ধারণাকে সমর্থন করে না। বড় পর্দা, প্রেক্ষাগৃহ ছাড়া একা সিনেমা দেখা সিনেমার আসল স্বাদটিই আসে না। করোনা মহামারিতে প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ, সেখানে বিকল্প অনলাইনের ভাবনাটা গেড়ে বসেছে। কিন্তু এই ব্যবস্থা সাময়িক। করোনা জয় করে মানব সভ্যতা স্বরূপেই অবস্থান নেবে। টেলিভিশন কখনও সিনেমার বিকল্প নয়। বিশ্বের সর্বাধিক সিনেমার নির্মাতা দেশ ভারত। সেখানে টেলিভিশন দর্শক কমাতে ভূমিকা রাখেনি বরং টেলিভিশন ভারতের সিনেমাকে নানাভাবে সহায়তা করছে। একটি সিনেমার প্রমোশনে টেলিভিশন বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে। ট্রেলার, সাক্ষাৎকার, সিনেমাটির বিহাইন্ড দ্য সিন, গানের দৃশ্য নানাভাবে দর্শকদের আগ্রহ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে। একটি সদ্য রিলিজ করা সিনেমার টিভি রাইট দেওয়া হয় দুই বছর বয়সী হলেই। ভারতের প্রযোজক গিল্ডের এই সিদ্ধান্ত কঠোরভাবে পালন করা হয়।
একটি পরিপূর্ণ পরিকল্পনা নেওয়ার সময় হয়ে গেছে চলচ্চিত্র নিয়ে। একদিকে তিনশ’ সংসদীয় আসনে তিনশ’ সিনেপ্লেক্স তৈরি করা, অন্যদিকে ভালো সিনেমা তৈরির উদ্যোগ। সরকারের কাছে বিশেষ নজরের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে চলচ্চিত্র শিল্পের সকলের। সরকার প্রধান ইতিমধ্যে সিনেমা হল উন্নয়নের জন্য কয়েকশ’ কোটি টাকার তহবিল গঠন করে দিয়েছেন। চলচ্চিত্রের আঁতুড়ঘর এফডিসি বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া। চলচ্চিত্রের যেকোনও সংকটে জননেত্রী হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন এর নজির রয়েছে অসংখ্য। নানা কারণে ভালো প্রযোজকরা সিনেমা থেকে দূরে সরে গেছেন। সব পক্ষের মধ্যেই সংকট নাড়া দিয়েছে, সব পক্ষই নিজেদের মধ্যে মত বিনিময় করছেন। সবাই একটি ঐকমত্য পোষণ করেন যে, সিনেমা দেখার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। সময়ের ব্যবধানে সিনেপ্লেক্সই হতে পারে পরিবেশ ফিরিয়ে আনার একমাত্র মাধ্যম।
প্রদর্শক সমিতির হিসেবে ষোল কোটি মানুষের দেশে সিনেমা হল সচল রয়েছে বাষট্টিটি। দুই বছর আগে এই সংখ্যা ছিল ২৬০টি। দেশের ২৫টি জেলায় এখন সিনেমা হলের অস্তিত্বই নেই। এ থেকেই সংকটটির ভয়াবহতা অনুমান করা যায়। চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত সকল পক্ষের কাছে আহ্বান রাখতে চাই, হাজার মানুষের রুজির ব্যবস্থা করছে চলচ্চিত্র, এই চলচ্চিত্র শিল্প বন্ধ হয়ে গেলে বেকারত্বের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতির চর্চার শূন্যতা সৃষ্টি হবে। আসুন সবাইকে নিয়ে চলচ্চিত্র বাঁচানোর পথ খুঁজি, সরকারের কাছে দাবি তুলি- ন্যূনতম তিনশ’ সংসদীয় আসনে তিনশ’ সিনেপ্লেক্স গড়ে তোলার জন্য। যার মাধ্যমে কোমায় চলে যাওয়া বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের জন্য অক্সিজেন জোগান।
লেখক: নির্মাতা ও প্রযোজক
সভাপতি, বাংলাদেশ ফিল্ম এন্ড মিডিয়া সোসাইটি
. . . . . . . . .