ইসলামী ব্যাংকগুলোর মুনাফায় বড় পতন

সিলেটের কন্ঠ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ আগস্ট ২০২৫, ১০:১৪ পূর্বাহ্ণদেশের ব্যাংক খাতে ২০২৪ সালের এক হতাশাজনক চিত্র ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংকগুলোতে মুনাফার প্রবৃদ্ধি ভয়াবহভাবে কমে গেছে। গত বছর ইসলামী ব্যাংকগুলোর নিট মুনাফা হয়েছে মাত্র ৬৭০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় তিনগুণ কম। অন্যদিকে সার্বিক ব্যাংক খাতে গত বছর নিট মুনাফা কমেছে প্রায় ১৮ শতাংশ। খেলাপি ঋণের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং এর বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণের কারণে নিট মুনাফায় এ ধস নেমেছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
ইসলামী ব্যাংকগুলো বরাবরই আমানত প্রাপ্তি ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল ছিল। তবে গত দুই বছরে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য সামনে আসায় বড় ধরনের চাপের মুখে পড়ে এই ব্যাংকগুলো। একদিকে আমানত প্রত্যাহার বেড়ে যায়, অন্যদিকে বিনিয়োগের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে ব্যাংকগুলোতে বিশেষ নিরীক্ষার কারণে খেলাপি বিনিয়োগ দ্রুত বাড়তে থাকে। এর বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে নিট মুনাফায় বড় প্রভাব পড়ে।
এ বিষয়ে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, খেলাপি ঋণের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিই নিট মুনাফা পতনের অন্যতম কারণ। রাজনৈতিক চাপসহ বিভিন্ন কারণে বিগত বছরগুলোতে খেলাপি ঋণ লুকিয়ে রাখার প্রবণতা ছিল। পটপরিবর্তনের পর সেই সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। বিশেষ নিরীক্ষার আওতায় এখন খেলাপি ঋণের আসল চিত্র বের হয়ে আসছে। এতে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেড়েছে। যার বড় প্রভাব পড়েছে নিট মুনাফায়।
নিয়মিত ও খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ ও কর পরিশোধের পর ব্যাংকের প্রকৃত বা নিট মুনাফা হিসাব করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকের নিট মুনাফা বাড়লে শেয়ারহোল্ডার ও বিনিয়োগকারীরা বেশি হারে লভ্যাংশ পান। আবার সরকারও বেশি রাজস্ব পায়। একই সঙ্গে ঝুঁকি মোকাবিলায় ব্যাংকগুলোর মূলধন বাড়ানোর সক্ষমতা তৈরি হয়। আর নিট মুনাফা কমলে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশও কমে যায়, যা ব্যাংকের শেয়ারের দামের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়ে দেয়। এ ছাড়া ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ বিতরণ ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে নিরুৎসাহিত হয়, যা সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে।
গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন-২০২৪ প্রকাশ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে ব্যাংক খাতের নিট মুনাফার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, গত বছর ইসলামী ব্যাংকগুলোর নিট মুনাফা হয়েছে মাত্র ৬৭০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে তাদের নিট মুনাফা ছিল ২ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। এক বছরে নিট মুনাফা কমেছে প্রায় ২ হাজার ৯০ কোটি টাকা বা ৩১১ শতাংশ। তার আগের তিন বছর টানা নিট মুনাফা বেড়েছিল।
জানা গেছে, ২০২৪ সালে কয়েকটি ইসলামী ব্যাংক মুনাফার পরিবর্তে লোকসান করেছে। সরকারি-বেসরকারি খাতে আরও কিছু ব্যাংকও লোকসানে পড়েছে। যার কারণে সার্বিক খাতেও নিট মুনাফায় ধাক্কা এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশের ব্যাংক খাতে সম্মিলিত নিট মুনাফা ১৮ শতাংশেরও বেশি কমে গেছে। ২০২৩ সালে যেখানে ব্যাংক খাতের সম্মিলিত নিট মুনাফা ছিল প্রায় ১৪ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা, ২০২৪ সালে তা কমে ১২ হাজার ১৫৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ এক বছরে ব্যাংক খাতের নিট মুনাফা কমেছে প্রায় ২ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা বা ১৮ দশমিক ০৭ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায়, করোনা মহামারী শুরুর বছর ২০২০ সালে ব্যাংক খাতে নিট মুনাফায় বড় ধাক্কা এলেও ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধি হয়। ২০১৯ সালে ব্যাংক খাতে নিট মুনাফা হয় ৬ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। ২০২০ সালে সেটি কমে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। এর পর ২০২১ সালে বেড়ে ৫ হাজার ২০ কোটি, ২০২২ সালে ১৪ হাজার ২৩০ কোটি এবং ২০২৩ সালে ১৪ হাজার ৮৪০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। তবে ২০২৪ সালে নিট মুনাফা কমে ১২ হাজার ১৫৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কিছু গ্রুপ ঋণের নামে বিপুল অঙ্কের অর্থ বের করে নিয়েছে। তাদের বড় অঙ্কের ঋণ দিতে নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে কম দেখাতে নেওয়া হয়েছিল একের পর এক নীতি। সরকার পরিবর্তনের পর সেই নীতি থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাংক খাতে গত মার্চ পর্যন্ত বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। গত বছর ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা বা ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। ফলে জানুয়ারি-মার্চ এই তিন মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে গত বছর সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা বা ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ফলে ছয় মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা। এদিকে গত বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা বা ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। ফলে গত এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা।