একজন অধ্যক্ষের বিদায়, ‘যিনি ছিলেন অনুপ্রেরণার দীপ্ত শিখা’

নিজস্ব প্রতিবেদক:
প্রকাশিত হয়েছে : ৩১ মে ২০২৫, ৪:৪৭ অপরাহ্ণ
সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজের ৫৩ তম অধ্যক্ষ হিসেবে অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) গেলেন প্রফেসর আবুল আনাম মো. রিয়াজ। চতুর্দশ বিসিএসের এই শিক্ষক কর্মকর্তা ১৯৯৩ সালের ২৭ নভেম্বর খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন এরপর ১৯৯৫ সালে ৮ এপ্রিল মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করার পর প্রায় ২৭ বছর শিক্ষকতা করেন। ৪ এপ্রিল, ২০২২ সালে সিলেট সরকারী কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। সর্বশেষ ১৭ এপ্রিল, ২০২৩ সালে মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেছিলেন প্রফেসর আবুল আনাম মো. রিয়াজ। এখান থেকেই ২৯ মে, বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থী ও সহকর্মীদের ভালোবাসায় অবসরোত্তর ছুটিতে গমন করেন এবং বিদায় সংবর্ধনা পেলেন এমসি কলেজের অধ্যক্ষ।
যেভাবে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান:
২৯ মে বৃহস্পতিবার ছুটির গ্রহণের শেষদিনে এই অধ্যক্ষকে নিয়ে ছিল নানা আয়োজন। শুরুতে কলেজের প্রশাসনিক ভবনে গার্ড অব অনার দেন কলেজের বিএনসিসি প্লাটুন। সালাম দেন রোভার স্কাউটস গ্রুপ। পরে বিসিএসের বিভিন্ন ক্যাডারের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মকর্তা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা এসে প্রফেসর আবুল আনাম মো. রিয়াজকে শুভেচ্ছা জানান। সকাল ১১:৩০ মিনিটে কলেজের অডিটোরিয়ামে শিক্ষার্থীদের আয়োজিত সংবর্ধনায় অংশ নেন তিনি। সেখানে কলেজের সকল বিভাগ ও সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা তাঁকে ফুলেল শুভেচ্ছা, বিভিন্ন উপহার ও স্মারক তাঁর হাতে তুলে দেন।
সংবর্ধনা জবাবে সংবর্ধিত প্রফেসর রিয়াজ বলেন, ‘আমি মুরারিচাঁদ কলেজের একজন শিক্ষার্থী থেকে এই ক্যাম্পাসের শিক্ষক ও অধ্যক্ষ হয়ে আজ অবসরে যাচ্ছি, এটা আমার জন্য বড় সৌভাগ্যের। ১২৪ একরের এই ভূমিতে প্রায় ২৯ বছরের স্মৃতিজড়িত। এই ক্যাম্পাসেই কয়েকজন শিক্ষক রয়েছেন যারা আমার সরাসরি শিক্ষার্থী ছিল এখন সহকর্মী হিসেবে শিক্ষাদান করছেন এটা আমার জন্য অত্যন্ত গর্বের ও আনন্দের। এই দীর্ঘ পথচলায় আমি চেষ্টা করেছি শিক্ষার্থীদের সাথে মিশে তাদের যুগোপযোগী একটি সুন্দর ক্যাম্পাস, সৃজনশীল পাঠদানের ব্যবস্থা ও দেশীয় সংস্কৃতি চর্চায় আগ্রহ করতে। জানিনা কতটুকু পেরেছি। আশা করি আপনারা ভালোভাবে লেখাপড়া করে দেশের একজন সৎ, দক্ষ, মানবিক নাগরিক হয়ে দেশের সেবা করবেন ‘
যা বলছে শিক্ষার্থীরা:
থিয়েটার মুরারিচাঁদ এর সভাপতি কামরুল ইসলাম তার অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, অধ্যক্ষ আবুল আনাম মো. রিয়াজ স্যার ছিলেন একজন বিদগ্ধ জ্ঞান তাপস। শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি এক অভিভাবকের মতো উদার, সহানুভূতিশীল এবং সবসময় পাশে থাকা এক অনন্য দৃষ্টান্ত। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা ও সম্পৃক্ততা কলেজকে করেছে আরো মানবিক ও সংস্কৃতিমুখর। তাঁর এই অসামান্য অবদান আমাদের হৃদয়ে চিরকাল গাঁথা থাকবে, অনুপ্রেরণার দীপ্ত শিখা হয়ে। এমন একজন স্যারকে পেয়ে আমরা সত্যিই গর্বিত ছিলাম। ক্যাম্পাসে স্যারকে খুব বেশি মিস করবো।
কামরুল ইসলাম
সভাপতি
থিয়েটার মুরারিচাঁদ
এমসি কলেজের বৃহৎ সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘মোহনা’ এর সভাপতি তাহিন আহমদ বলেন, ‘প্রফেসর রিয়াজ স্যার শুধু একজন শিক্ষক বা অধ্যক্ষ নন বরং মুরারিচাঁদ কলেজের ১২৪ একরের ক্যাম্পাসের তিনি ছিলেন প্রাণপুরুষ । তিনি একজন শিক্ষার্থী বান্ধব শিক্ষক। তিনি একজন অনুপ্রেরণার বাতিঘর, একজন পথপ্রদর্শক এবং একজন ডায়নামিক লিডার’। অবসরকালীন সময়েও স্যার সমাজে আলো ছড়াবেন-এমন প্রত্যাশা করে স্যারের দীর্ঘজীবন কামনা করি।
তাহিন আহমদ
সভাপতি
মোহনা সাংস্কৃতিক সংগঠন
মুরারিচাঁদ কবিতা পরিষদ এর সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী জাবের জানায়,সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী কলেজের সম্মানীয় অধ্যক্ষ প্রফেসর আবুল আনাম মো. রিয়াজ স্যার। তিনি শুধু আমাদের অধ্যক্ষই ছিলেন না, এমসি কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী, প্রভাষক, অধ্যাপক এবং আমাদের এমসি কলেজ পরিবারের অভিভাবক ছিলেন। রিয়াজ স্যার এমসি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যুক্ত হওয়ার পর কলেজের শিক্ষা, আধুনিকতা, সৃজনশীলতা কাজ ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডসহ সকল নৈতিক কাজে স্যারের অবদান অস্বীকার্য। একজন স্মার্ট ও সৃজনশীল মানুষ আমাদের স্যার। সাংস্কৃতিক কাজ করতে গিয়ে স্যারের পরামর্শ ও ভালোবাসা আজীবন মনে থাকবে।
মোহাম্মদ আলী জাবের
সাধারণ সম্পাদক
মুরারিচাঁদ কবিতা পরিষদ
এমসি কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক লবীব আহমদ জানায়, প্রফেসর আবুল আনাম মো. রিয়াজ স্যার, যিনি একজন শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষক, শিক্ষার্থীবান্ধব অধ্যক্ষ, একজন দক্ষ প্রশাসক, আপোষহীন ব্যক্তি ও নিরহংকারী, সদা প্রফুল্ল মানুষ। একজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যেরকম সম্পর্ক থাকা দরকার, তাঁর মাঝে তার সবই আছে। তিনি শিক্ষার্থীদের সাথে মিশতেন, সব খবর নিতেন, পাশে থাকতেন, ভালোবাসতেন। ক্যাম্পাস ও শিক্ষার্থী, সহকর্মী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই ছিল তাঁর সব। তাঁর সুনিপুণ নেতৃত্বে এমসি কলেজ শিক্ষার্থীদের আনাগোনায় মুখরিত থাকে। তাঁর বিদায়ে কলেজের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের ফেলা চোখের পানিই বলে দেয় তিনি কতটা আপন ছিলেন তাদের আর তিনি তাদের কতটা আপন করে নিয়েছেন। সবসময় ভালো থাকবেন স্যার, ১২৪ একরের সবুজ আঙ্গিনা আপনাকে মিস করবে।
লবীব আহমদ
সাধারণ সম্পাদক
এমসি কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি
দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী ইমরান আলী জানায়, আমাদের অধ্যক্ষ স্যার আমাদের প্রেরণার উৎস। সদা হাস্যোজ্জ্বল ও অসাধারণ পাণ্ডিত্যপূর্ণ আমাদের অধ্যক্ষ স্যার সর্বদাই বিনয়ী, সদয় এবং উৎসাহব্যঞ্জক ছিলেন। শিক্ষার মান বৃদ্ধি, শিক্ষক শিক্ষার্থী বন্ধন, শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে সার সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। নিয়মিত ক্লাসরুম মনিটরিং ও শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাস করতে উৎসাহিত করতেন। পড়াশোনার একঘেয়েমি কাটাতে শিক্ষা সফর, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন ও অংশগ্রহণে উৎসাহ দিতেন। শিক্ষার্থীদের জীবনমুখী উপদেশ এবং সুন্দর ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিতেন। শিক্ষাদান, নেতৃত্ব, সততা ও ন্যায়নিষ্ঠায় স্যার অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। স্যারের বিদায়ে আমরা অত্যন্ত ব্যতীত। স্যারের অবসরোত্তর জীবন অনাবিল সুখ ও শান্তিতে কাটুক এই কামনা করি।
ইমরান আলী
দ্বাদশ শ্রেণি
মুরারিচাঁদ কলেজ, সিলেট
একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী মৃন্ময়ী ভট্টাচার্য জানায়, স্যারকে আসলে একলাইনে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। মুরারিচাঁদ কলেজে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য রিয়াজ স্যার অনেক সাহায্য করেছেন। আমি ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি তখনি সিলেট এসে স্যার এর সাথে দেখা করি। আমার একটি স্মৃতি মনে পড়ে স্যার তখন আমাকে বলেছিলেন, মন দিয়ে পড়ালেখা করতে হবে বড় হয়ে আমি যেন মুরারিচাঁদ কলেজে এ চান্স পাই সেদিন আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন। আজ আমি মুরারিচাঁদ কলেজের একাদশ শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থী। স্যার এতটাই আন্তরিক স্যার যে সকল শিক্ষার্থীদের জন্য সব রকম সাহায্য করতে তিনি রাজি। সম্প্রতি একটি প্রতিযোগিতায় যাওয়ার জন্য আমরা কয়েকজন পরীক্ষা দিতে পারি নাই। তিনি নিজে ব্যবস্থা করেছেন যেনো পরীক্ষা দিতে সমস্যা না হয়। আমাদের জন্য কলেজ থেকে গাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেন তিনি।
মৃন্ময়ী ভট্টাচার্য
একাদশ শ্রেণি
মুরারিচাঁদ কলেজ, সিলেট
সিলেট/আবির/এমসি