অণুগল্প: শবযাত্রা
সুলেখা আক্তার শান্তা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ৬:১৯ অপরাহ্ণহাঁটা শুরু করলাম। সামনে তাকাতে দেখি একটা শবযাত্রা এগিয়ে আসছে বিপরীত দিক থেকে। মুর্দা দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। হয়তো কাছাকাছি কোথাও কবরস্থান। আমি এক পাশে সরে দাঁড়ালাম শবযাত্রাকে পথ করে দিতে। হঠাৎ করে লক্ষ্য করি একটা লোক শবযাত্রা থেকে বেরিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। লোকটার চেহারা পরিচিত মনে হলো কিন্তু কোথায় তাকে দেখেছি মনে করতে পারছিলাম না। দুঃখ ভারাক্রান্ত চেহারা তার। এগিয়ে এসে কোন ভূমিকা না করে বলল, আমি দুঃখিত মাফ করে দিবেন। চকিতে মনে পড়ে গেল সেই ঘটনা। দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়া সাধারণত বিরল ঘটনা। ক্ষমাপ্রার্থী লোকটির প্রতি যথাসম্ভব বিনয় প্রকাশ করে জিজ্ঞেস করলাম, কে মারা গেছে? ছলছল চোখে তিনি বললেন, আমার মা। শবযাত্রা তখন বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে। শবযাত্রায় শামিল হতে তিনি দ্রুত এগিয়ে গেলেন সঙ্গীদের দিকে।
ঘটনার আকস্মিকতায় তখন আমি হতবিহ্বল। এমন ঘটনাও ঘটতে পারে। সেটা কয়েকদিন আগের কথা। স্বভাবতই বাসে প্রচন্ড ভিড়। আমার পাশে বসে ছিলেন শবযাত্রার ক্ষমাপ্রার্থী ওই ভদ্রলোক। লক্ষ্য করলাম বাসের প্রতিটি ঝাঁকুনি তিনি সদ্ব্যবহার করছেন আমার উপর ঢোলে পড়ে। কখনো ঠেলা কখনো ধাক্কার ছন্দায়িত ধারায়। প্রতিনিয়ত এহেন বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হয় মেয়েদের। এসব ঘটনার প্রতিবাদ খুব কমই হয়। বাসের ভিড়, ঝাঁকুনি ইত্যাদির দোহাই দিয়ে উপস্থিত সবার সমর্থন আদায় করে নেওয়া হয় অবলীলায়। প্রতিবাদ করলে সৃষ্টি হয় আর এক বিড়ম্বনার। প্রতিবাদীকে লজ্জিত অপরাধীর মতো মুখ বন্ধ করে চুপ করে যেতে হয়। আমার পাশে বসা ভদ্রলোকের বেসামাল অবস্থা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। নিরুপায় আমি যথেষ্ট সংযত হয়ে তাকে একটু সামলে থাকতে বলি। উনি যেন আক্রমণের জন্য তৈরি হয়ে ছিলেন। আমার ওপর শুরু করলেন প্রবচন বর্ষণ। বাসের ঝাকুনি, আমাদেরও মা বোন আছে, আমরা অমানুষ না ইত্যাদি রাজ্যের কথা! আমি লজ্জায় মরে যাই! ভাবছিলাম বলি, আপনি ঠিক কাজ করেছেন আমিই ভুল করেছি। পরিশেষে তিনি যে কথাটি বললেন আমার ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করলো।
‘এরকম হলে প্রাইভেট গাড়িতে চলাফেরা করা উচিত।’ মাথায় যেন আগুন ধরে গেল আমি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো উঠে দাঁড়ালাম। বাসের হেলপারকে বললাম নামিয়ে দিতে। হেলপার বললো, এখানে নামবেন কোথায় কোন গাড়ি তো পাইবেন না। তবু আমি জোর করেই নেমে গেলাম। সত্যিই সেদিন কোন গাড়ি পাইনি, আমি প্রায় হেঁটেই বাড়ি ফিরেছিলাম। ঘটনাটি মনে যে যন্ত্রনা সৃষ্টি করেছিল অপ্রত্যাশিত এই ঘটনায় তা কিছুটা প্রশমিত হলো। তাকিয়ে দেখলাম, শবযাত্রাটি আমার দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেছে। ভাবছিলাম, ভদ্রলোকের মায়ের মৃত্যু হয়তো তার উপলব্ধি লাভে সহায়ক হয়েছে কিন্তু সব ক্ষেত্রে তা তো হবার নয়।
সাহিত্য/হা