ছোটগল্প: অন্তিম শান্তি
সুলেখা আক্তার শান্তা
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ অক্টোবর ২০২৪, ৪:৫৪ অপরাহ্ণআমি আর থাকবো না এখানে। এখানে কি আমার কোন আত্মীয়-স্বজন আছে যে আমি তাদের কাছে থাকবো। কে ভাববো আমার কথা! কেউ নাই আমার। কথা কথাগুলো বলার সময় কাঁদছিলেন মমতা। দীর্ঘদিন চাকরি করেছি। টাকা পয়সা কিছু জমা ছিল। কিন্তু নিজের টাকা নিজে ভোগ করতে পারি নাই। সব দিছি মেয়ের জামাইকে। এখন মামার বাড়ি দহত্তরি মানে মাতৃকুলের প্রাপ্ত সম্পত্তি ভোগ করতেছি। এখানে জমি জমা না থাকলে কোথায় দাঁড়াইতাম? মা মারা গেছে। বাপরে ছোটবেলায় দেখছি তারপর সেই যে নিরুদ্দেশ হইল তাঁর আর দেখা পাওয়া যায় নাই। থাকার মধ্যে আছে এক মেয়ে তার দেখাও পাই না। জামাই দেখা করতে দেয় না মেয়ের সঙ্গে। মামাতো ভাই আজাদ মিয়া বোনের কথাগুলো শুনছিল। সে বলেন, বুবু তোমারে কি আমরা কোন কম আদর করি? তোমারে বললাম তুমি আমাদের সঙ্গে খাও তা তুমি খাবা না। তোমার ভাগের সম্পত্তি চাইলা তাও তোমাকে ভাগ করে দিয়ে দিলাম। নিয়তি বুবু! তোমার কপালে যা আছে তা তুমি মেনে নাও। মমতা বলেন, মেনে নেওয়া ছাড়া কী উপায় আছে আর। বাপ মার ঘরে সুখ করতে পারলাম না। বিয়ে হইল স্বামীর ঘর সংসার করতে পারলাম না। আজাদ ভাই আমার তুই একটা কাজ কইরে দে। তুই আমার মেয়ের বাড়ি যা। জামাইকে বুঝাইয়া মেয়েটারে দুই দিনের জন্য বেড়াইতে নিয়ে আয়। ওর জন্য পরানটা ছটফট করে। আজাদ বলেন, ঠিক আছে বুবু তুমি যখন বলছ আমি যাব। আজাদ মিয়া শিলার শ্বশুর বাড়িতে যায়। শিলাকে বলে, মা তোকে নিতে এসেছি। কয়টা দিন তোর মায়ের কাছে থেকে আসিস। শিলা বলে, মামা আমার তো যেতে মন চায় কিন্তু আপনাদের জামাই তো যেতে দিব না। আজাদ বলেন, আমি জামাই বাবাজিকে বলি। শিলার উত্তর, দেখেন বলে, যেতে দেয় কিনা। আজাদ মিয়া দ্বিধা নিয়ে কথাটা রিফাতকে বলেন। রিফাতের রুঢ় উত্তর, না আমি আমার বউকে কোথায়ও যেতে দেব না। আজাদ মিয়ার হতাশ চেহারা দেখে আর একটা কথা যোগ করে রিফাত। যেতে দিতে পারি এক শর্তে। আমার শাশুড়ির যে জমি আছে সেইটা বিক্রি কইরা আমাকে টাকা দিতে হবে। তাহলে আমি আপনাদের মেয়েকে যেতে দিতে পারি। আজাদ মিয়া এতক্ষণ সংযত ছিল এবার রাগ হয়ে বললেন, এইটা তুমি কী বললা? তোমার শাশুড়ির তিন কুলে কেউ নাই। এক আছে মেয়ে তাকে তুমি মায়ের কাছে যেতে দিবানা? রিফাত বলে, আমি স্বামী আমার কথা অমান্য করে গেলে আমি তাকে নিয়ে সংসার করবো না। একথা শুনে আজাদ মিয়া স্তম্ভিত। দুনিয়া অনেক দূর এগিয়ে গেলেও এমন মানসিকতা এখনো বহাল তবিয়তে বিরাজমান। আজাদ বলেন, এটা কী ধরনের কথা। মেয়ে মায়ের কাছে গেলে তাকে নিয়ে তুমি সংসার করবা না। ঠিক আছে, মেয়ের মায়ের কাছে যাওয়ার দরকার নেই। আজাদ মিয়া চলে যান। বোনকে গিয়ে বলেন, বুবু তোমার মেয়েকে তোমার কাছে আনতে পারলাম না। জামাইয়ের এক কথা, মেয়ে যদি নিতে চাও তোমার এই বসতভিটা বিক্রি করে তাকে টাকা দিতে হবে। হায়রে মানুষের লোভ! আজাদ মিয়ার স্ত্রী জাহেদা অপেক্ষায় ছিল সে কথা শোনাতে ছাড়ে না। শ্বশুর বাড়ির সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা তার মনঃপুত ছিল না। জাহেদা মমতাকে বলেন, তুমি তাড়া দিয়া আমাদের কাছ থেকে সম্পত্তি ভাগ করে নিলা এখন তাড়া খাইয়া বোঝো ঠ্যালা। জমিটা লইছেন আমার স্বামীর গলায় পাড়া দিয়া। সেই সম্পত্তি কি আর থাকে! কোন বিষয়ে আমার স্বামীকে আপনি ডাকবেন না। আমার স্বামী আপনার কোন কাজে কোন বিষয় যাইবো না। আজাদ মিয়া স্ত্রীকে থামাতে চেষ্টা করে কিন্তু পারেন না। জাহেদা এবার চুপ থাকো। উনার ভাগের সম্পত্তি উনি নিছে তাতে কী হইছে? অন্য কারোটা তো নিতে আসে নাই। জাহেদা জেদ করে বলেন, নিতে আসে নাই জানি। ভাগেরটা ছিল বলেই তো নিতে দিছি। মমতার দিকে আঙ্গুল উঠিয়ে বলেন, সম্পত্তি খাওয়া অতো সহজ না। মেয়ের জামাই সম্পতি খাওয়ার জন্য হা করে বসে আছে। এখন দেখব সম্পত্তি নিজের করে কেমনে রাখেন। মমতা উচ্চস্বরে বলেন, হ্যাঁ তা তো বলবাই। নিরুপায় হলে সবার কাছে কথা শুনতে হয়। তোমার স্বামী তার আগে ও তো আমার ভাই। বোনের কাজে ভাই আসবে না? জাহেদা কিছুতেই শান্ত হয় না। বলেন, এতই যদি ভাই মনে করো ভাইয়ের কাছ থেকে কেউ ওই ভাবে সম্পত্তি নেয়? মমতা বলেন, আমি ছিলাম নিরুপায়। আমার যদি থাকতো আমি নিতাম না। তোমাদের বলার কথা তোমরা তো বলবাই। আমার রাগ অভিমান দুঃখ যাই হোক!
মমতা অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেবা যত্ন, ডাক্তারের কাছে নেওয়া কোন মানুষ নাই তাঁর। শুধু কেঁদে কেঁদে বলেন, মেয়ের মুখটা যদি একটু দেখতে পারতাম। মমতা লাঠি ভর করে ভাইয়ের বউয়ের কাছে যান। জাহেদাকে অনুনয় করে বলেন, বোন রাগ কইরো না। মেয়েটারে আমার বড়ই দেখতে ইচ্ছা করে। আজাদরে দিয়া যদি একটু খবর দিতো আমার মেয়ের কাছে। মমতার চোখের অশ্রু দেখে জাহেদার মায়া হয়। ঠিক আছে আপনার ভাইরে পাঠাবো। আজাদ মিয়া শিলার শ্বশুর বাড়ি যান। মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে আজাদের সঙ্গে রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। রিফাত সামনে এসে দাঁড়ায়। তুমি যেতে পারবা না। যদি যাও এটাই হবে তোমার শেষ যাওয়া। তবে আমি যেতে দিতে পারি, তোমার মায়ের সম্পত্তিটা যদি আমার নামে লিখে দেয় তাহলে। শিলা স্বামীর অবাধ্য হতে চায় না। মায়ের জন্য তার বুক ফেটে যায়।
শিলা বলে আজাদ মিয়াকে, মামা আমি মায়ের কাছে তখনই যেতে পারব তাঁর সম্পত্তি যদি মা আমার স্বামীর নামে দিয়ে দেয় তাহলে। প্রতিউত্তরে আজাদ মিয়া বলেন, রিফাত যা চায় আমি তাই করে দিতে বলব বুবুকে। আজাদ মিয়া বাড়ি ফিরে বলেন, বুবু তোমার জামাই একটা অমানুষ। সম্পদ সম্পত্তি ছাড়া কিছু বোঝেনা! মেয়ে তখনই আসতে পারবে যখন তুমি তোমার সম্পত্তি মেয়ের জামাইকে দিয়ে দিবা। মমতা হাফ ছেড়ে বলেন, ভাই বাঁচি কি মরি জানিনা। তুই সম্পত্তি মেয়ের জামাইকে দিয়ে দেবার ব্যবস্থা কর। আমি শেষ সময়ে আমার মেয়ের মুখটা দেখে যেতে চাই। রিফাতের নামে সম্পত্তি দেওয়া হবে তাই সে স্ত্রীকে নিয়ে আসে। সম্পত্তি বুঝিয়ে পেয়ে সে খুশি। তার কৌশলে সাফল্য এসেছে। মনে মনে বলে একটু শক্ত না হলে কাজ হয় না। রিফাত সম্পত্তি যাঁর কাছে বিক্রি করে তাঁকে মমতা বলেছিল, আমার একটা অনুরোধ রাখতে হবে। যে কয়দিন মৃত্যু না হয় আমি এই ঘরটার মধ্যে সে কয়দিন থাকতে চাই। ক্রেতা কথা রেখেছিল। কিছুদিনের মধ্যে সেই সময় উপস্থিত হলো। দুনিয়ার অগণিত বঞ্চিত লাঞ্ছিত নারীর মতো নীরব দুঃখ নিয়ে মমতা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। সে একটু জায়গা রেখেছিলেন নিজের কবরের জন্য। সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়।
সাহিত্য/হা