পুলিশি নিরাপত্তা : বজ্র আঁটুনির ফসকা গেরো
ইয়াহিয়া নয়ন
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ নভেম্বর ২০২২, ৩:০২ অপরাহ্ণএক শ্রেনীর পুলিশ সদস্যদের নিয়ে অনেক মন্দ কথা প্রচলিত আছে। ছিনতাই, ডাকাতি, ধর্ষণ, হত্যা, অপহরণ- এমন কোনো অপরাধ নেই যা নিয়ে ওইসব পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই। দেশের প্রায় সব জেলখানাতেই সাজাপ্রপ্ত পুলিশ সদস্য পাওয়া যাবে। অপরাধ করলে তাদের সাজা হয় বরখাস্ত অথবা বদলি। বিভাগীয় সাজা ছাড়া বড় অপরাধী যারা তারা যায় আইনের মাধ্যমে জেলে। সব মিলিয়ে অপরাধী পুলিশের সংখ্যা কম নয়।
পুলিশ জনগণের বন্ধু তথা জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করবে এবং তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব-কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করবে এমনটাই সবার প্রত্যাশা। কিন্তু যখন দেখা যায়, কিছু পুলিশ সদস্য তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব-কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করেন না বা দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দেন, তখন বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। ইদানীং দেশের কারাগার, হাসপাতাল ও আদালত থেকে প্রায় নিয়মিতভাবেই কারাবন্দি বা আসামি পালানো বা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। ২০ নভেম্বর দুপুরে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) আদালত ফটকের সামনে থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামির (২৪) ও মো. আবু ছিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিবকে (৩৪) তাঁদের সহযোগীরা পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যসহ জেলারদের দায়িত্বে-কর্তব্যে অবহেলার প্রমাণ পাওয়া যায়, অন্যদিকে এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে কারাগারের বা পুলিশি হেফাজতের নিরাপত্তাব্যবস্থা যে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, তা পরিস্কার।
তাদের দায়িত্বে-কর্তব্যে অবহেলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হচ্ছে পুলিশ হেফাজত থেকে আসামি পলায়নের ঘটনা। আমাদের দেশে এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়, যা দুঃখজনক। পুলিশ হেফাজত থেকে যদি আসামি পলায়ন করে বা ‘বিশেষ সুবিধা’র কারণে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্য কর্তৃক আসামিকে পালানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে একদিকে যেমন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা কঠিন বিষয় হয়ে পড়ে, অন্যদিকে ভুক্তভোগীও ন্যায্য প্রতিকার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন। সর্বোপরি পলায়নকারী আসামি ভুক্তভোগী ব্যক্তি বা সাক্ষীদের জন্য এবং সাক্ষ্যের জন্য বিরাট হুমকি বা ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। এমন লোভী পুলিশের সংখ্যা এখন অনেক।
দেশে পুলিশ হেফাজত থেকে এবং কারাগার থেকে অনেক সময় সাধারণ আসামি থেকে শুরু করে হত্যা মামলার আসামি পর্যন্ত পালিয়ে যাওয়ার অনেক নজির রয়েছে। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যেমন গত বছরের ৬ মার্চ চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ফরহাদ হোসেন রুবেল নামের এক বন্দি উধাও হয়ে যান। ২০২০ সালের ৬ আগস্ট কাশিমপুর কারাগার থেকে মইয়ের সাহায্যে পালিয়ে যান যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি আবু বক্কর ছিদ্দিক। তা ছাড়া ওই একই বছরের ২৬ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলায় পুলিশের কাছ থেকে পালিয়ে যান গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত মো. পলাশ নামের এক আসামি। এর আগে চাঁদপুর জেলা কারাগার থেকে মোখলেছুর রহমান নামের বিচারাধীন মামলার এক আসামি দেয়াল টপকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া ২০১৯ সালের ১৮ জুন নোয়াখালী জেলা জজ আদালতের হাজতখানা থেকে কারাগারে নেওয়ার পথে হাতকড়াসহ পালিয়ে যান সাহাব উদ্দিন ওরফে সুজন নামের মাদক মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত আসামি। হত্যা মামলার আসামি কিংবা পুলিশের হেফাজতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আসামি পলায়নের পাশাপাশি ধর্ষণ মামলার আসামি পর্যন্ত পলায়নেরও ঘটনা ঘটে। ২০১৬ সালের ২৫ অক্টোবর রাজধানী ঢাকার উত্তর বাড্ডায় এক গারো তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এর সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে এক ডজন মামলার আসামি রাফসান হোসেন রুবেলকে গ্রেপ্তারের জন্য ব্যাপক তৎপরতা চালায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। এক পর্যায়ে র্যাবের হাতে ধরা পড়েন রুবেল। পরে তাঁকে আদালতে তোলা হয় এবং পুলিশের কর্তব্যরত দুজন সদস্যের ‘চোখ ফাঁকি’ দিয়ে তিনি হাতকড়াসহ আদালত থেকে পালিয়ে যান। আবার থানা থেকেও আসামি পালানোর ঘটনা দেখা যায় অনেক সময়। যেমন ২০১৫ সালের ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর পল্লবী থানা থেকে আতিকুর রহমান ওরফে সূর্য নামে রিমান্ডে থাকা এক আসামি পালিয়ে যান।
বিচারের কাঠগড়া থেকেও আসামি পালানোর ঘটনা ঘটতে দেখা যায় এ দেশে। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ দেশের বহুল আলোচিত ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জুবায়ের হত্যা মামলার চার আসামির আদালত থেকে পালানোর ঘটনা। জুবায়ের হত্যা মামলার চার আসামি আশিকুর রহমান, খান মোহাম্মদ ওরফে রইস, মাহবুব আকরাম ও ইশতিয়াক ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি আদালতের কাঠগড়া থেকে পালিয়ে যান। ওই দিন দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪-এ ওই মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ ও ছয় আসামির জামিন বাতিলের বিষয়ে আদেশের দিন ধার্য ছিল। বিচারক আসামিদের জামিন বাতিলের আদেশ দেওয়ার পর আদালতে উপস্থিত ওই চার আসামি কাঠগড়া থেকে পালিয়ে যান। এসবের পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ীও পুলিশের হেফাজত থেকে পালানোর ঘটনা ঘটে। যেমন ২০১৬ সালের ১১ মার্চ কক্সবাজারের টেকনাফে আটকের পর থানায় নিয়ে যাওয়ার সময় হাতকড়া পরা অবস্থায় পালিয়ে যান ইয়াবা ব্যবসায়ী নুরুল হুদা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ৭৬৪ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীর মধ্যে তাঁর নাম ছিল এক নম্বরে। উল্লিখিত ঘটনা ছাড়াও পুলিশ হেফাজত ও কারাগার থেকে আসামির পালিয়ে যাওয়া, ছিনিয়ে নেওয়ার অনেক নজির রয়েছে।
১৮৬১ সালের পুলিশ অ্যাক্ট-এর ২৯ ধারায় পুলিশ সদস্যদের দায়িত্বে অবহেলার জন্য সুস্পষ্টভাবে শাস্তির কথা বলা আছে। অনেক সময় দেখা যায়, এ ধরনের ঘটনা ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যকে শাস্তি হিসেবে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় বা জেলার বা ডেপুটি জেলারকে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলাকারীরা ‘ছাড়’ পেয়ে যান। পুলিশ হেফাজত থেকে আসামি পালিয়ে যাওয়ার পেছনে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যরা আসামির পক্ষ থেকে ‘বিশেষ সুবিধা’ নিয়ে থাকেন কি না সে বিষয়গুলোও সরকার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবার ভালোভাবে খতিয়ে দেখা দরকার। আর এ ধরনের ঘটনা কেউ ঘটিয়ে থাকলে পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ঠিক রাখতে এসব ঘটনার সঠিক তদন্তপূর্বক দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা জরুরী।
বেড়ায় খেত খেয়ে ফেলবে, এমনটা কেউ আশা করেনা। কারাগারের জেল সুপার ও জেলার যদি কারা অভ্যন্তরে নিয়মিতভাবে তদারকি করেন; ডেপুটি জেলাররা যদি তাঁদের নির্দিষ্ট এলাকাগুলো নিয়মিত তদারকিপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন; কারারক্ষীরা যদি নিষ্ঠা আর আন্তরিকতার সঙ্গে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন এবং আদালতে আসামি নিয়ে যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে জনবল বাড়ানো হলে, নিয়মিত সঠিকভাবে তদারকি ও দায়িত্ব পালন করলে আসামি পালানোর বা ছিনতাই হওয়ার সুযোগ থাকবে বলে মনে হয় না। পুলিশ বাহিনী এবং জেলার সম্পর্কে জনগণের ভালো ধারণা বজায় রাখতে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে এবং সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যসহ জেলারদের দায়িত্বশীলতার সর্বোচ্চ পরিচয় দিতে ভবিষ্যতে আর কোনো আসামি যেন পুলিশ হেফাজত থেকে পালানোর সুযোগ না পায়, ছিনতাই না হতে পারে, সেদিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়া আমাদের পুলিশ বিভাগের আরও আধুনিকায়নের প্রয়োজন রয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।






