নভেম্বর ১৯৭৫ এবং জেলহত্যা

ইয়াহিয়া নয়ন
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ নভেম্বর ২০২২, ৫:১৫ অপরাহ্ণ৪ নভেম্বর সকালে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলে অফিসাররা খালেদ মোশাররফ ও সাফায়াত জামিলের অপেক্ষায়। তাদের আগ্রহ ১৫ আগস্টের হোতাদের দেশ ছাড়ার পরবর্তী পদক্ষেপ জানা। সকাল ৯টার দিকে সাফায়াত জামিল এসে পৌঁছান। আরও কিছুক্ষণ পর খালেদ মোশাররফ এনএসআই প্রধান ই এ চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়কের রুমে প্রবেশ করেন। সেখানেই সেনা অফিসাররা প্রথমবারের মতো ই এ চৌধুরীর মুখে গত রাতের নারকীয় জেল হত্যার কথা শোনেন। এ সংবাদ বোমা বিস্ফোরণের মতো সকলকে হতবাক করে দেয়। প্রায় ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পর খবর শুনে সাফায়াত জামিল উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তিনি খালেদ মোশাররফকে অন্যান্য চীফ সহকারে বঙ্গভবনে গিয়ে প্রকৃত ঘটনা এবং পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের অনুরোধ জানান। ১১টার দিকে খালেদ মোশাররফ ই এ চৌধুরীকে নিয়ে বঙ্গভবনে যান। তাদের সঙ্গে বঙ্গভবনে এসে যোগ দেন দুই বাহিনীর প্রধানও। মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান ও জেনারেল ওসমানী আগে থেকেই সেখানে অবস্থান করছিলেন।
দিনভর কোন খবর না পেয়ে সন্ধ্যার পর সাফায়াত জামিল বঙ্গভবনে এসে উপস্থিত হন। বঙ্গভবনে তখন মন্ত্রিসভার বৈঠক চলছে। সাফায়াত জামিলের উপস্থিতির পর ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয়। খালেদ মোশাররফ ও অন্যদের নির্বিকার বসে থাকতে দেখে সাফায়াত জামিল রাগে ফেটে পড়েন এবং কিছুটা উচ্চস্বরে খালেদ মোশাররফের সঙ্গে বাগ্বিতন্ডায় লিপ্ত হন। জেলহত্যার খবর পেয়েও কেন কেবিনেট মিটিং চলতে দেয়া হচ্ছে তার ব্যাখ্যাও তিনি জানতে চান। মেজর জেনারেল খলিল এ ঘটনা জেনেও কেন নিশ্চুপ ছিলেন তার কৈফিয়তও চান তারা দুজন। এ নিয়ে তিনজনের মঙ্গে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয় এবং পুরো বঙ্গভবন তোলপাড় হয়ে যায়। সাফায়াত জামিল উত্তপ্ত অবস্থায় খুলিলুর রহমানকে বঙ্গভবন ত্যাগ করতে নিষেধ করেন।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে যখন খালেদ মোশাররফের পদোন্নতির অনুমোদন হয়, ঠিক সেই সময় এনএসআই প্রধান মন্ত্রিসভা বৈঠকে খন্দকার মোশতাককে জেলহত্যার ঘটনা আনুষ্ঠানিকভাবে জানান। ৩ নবেম্বর ভোরে সংঘটিত জেল হত্যার খবর ৪ নবেম্বর সন্ধ্যায় মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রকাশ করা হয় ঘটনার ২৪ ঘণ্টার পর। খবর শুনে খন্দকার মোশতাক হতবাক হওয়ার অভিনয় করেন এবং চার নেতার মৃত্যুতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এটা শোনার পর সাফায়াত জামিল আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি কয়েকজন অফিসার নিয়ে ঝড়ের বেগে কেবিনেট রুমে প্রবেশ করে খন্দকার মোশতাকের দিকে চিৎকার করে ইংরেজীতে বললেন, ‘আপনি খুনী ও ক্ষমতা দখলকারী। আপনি আর প্রেসিডেন্ট থাকতে পারেন না। আমি আপনাকে গ্রেফতার করছি, আপনার ক্ষমতায় থাকার কোন অধিকার নেই, এখনই পদত্যাগ করুন।’ এতে মন্ত্রিসভায় উপস্থিত সকলের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। মন্ত্রীরা ভীত হয়ে পড়েন এবং খন্দকার মোশতাক পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে ভীষণভাবে ভেঙ্গে পড়েন। এ সময় জেনারেল ওসমানী কক্ষে প্রবেশ করে সাফায়াত জামিলকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। এতে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়। তখন শাফায়াত জামিল জেলহত্যার ঘটনায় তাহের উদ্দিন ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও ওবায়দুর রহমানকে গ্রেফতার করে পুলিশের হাতে তুলে দেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর চার জাতীয় নেতার হত্যাকান্ড সারা জাতিকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। বিশ্বের কাছে জাতি হিসেবে নত করেছিল আমাদের। দুনিয়ার আর কোথাও জেলখানায় এই পর্যায়ের ইতিহাস সৃষ্টিকারী জাতীয় নেতারা হত্যাকান্ডের শিকার হননি।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে রাজনৈতিক দিক থেকে যে প্রতিরোধের আশা ছিল, এই হত্যাকান্ড সেটি শেষ করে দেয়। বাংলাদেশের জনগণ সারা পৃথিবীকে যে রকম অনেক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের দিন উপহার দিয়েছে, একইভাবে কিছু কুলাঙ্গারের জন্য বিশ্ব ইতিহাসে কয়েকটি কলঙ্কিত দিনের অধিকারীও হয়েছে। ৩ নবেম্বর ঠিক তেমনি একটি দিন।
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগারে বন্দি থাকাবস্থায় তাঁর অবর্তমানে ১৯৭১ সালে জাতীয় চার নেতা মুজিবনগর সরকার গঠন, রণ নীতি ও রণ কৌশল প্রণয়ন, প্রশাসনিক কর্মকান্ড ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, কূটনৈতিক তৎপরতা, শরণার্থীদের তদারকিসহ মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধে পরিণত করতে অসামান্য অবদান রাখেন। জাতি তাদের অবদান চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে জাতীয় চার নেতা হত্যাকান্ড ছিল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ধারাবাহিকতা। এ ঘৃণ্য হত্যাকান্ডের মাধ্যমে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি, দেশ বিরোধী চক্র বাংলার মাটি থেকে আওয়ামী লীগের নাম চিরতরে মুছে ফেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস এবং বাঙ্গালি জাতিকে নেতৃত্ব শূন্য করার অপচেষ্ট চালিয়েছিল।
মোশতাক গংদের নোংরা এবং কুৎসিত চিন্তাই তাদেরকে এই নির্মম হত্যাকান্ডের দিকে ধাবিত করে। রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের নেতৃত্বে তারা ৫ জনের একটি ঘাতক দল গঠন করে। ঠান্ডা মাথায় খুনের ব্যাপারে এ ঘাতক দলের সদস্যরা ছিল বিশেষভাবে পারদর্শী। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের কিছুদিন পর মোসলেহ উদ্দিনকে অনারারি লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত করা হয়। ১৫ অগাস্ট শেখ মনির বাসায় হত্যাযজ্ঞে নেতৃত্ব দিয়েছিল এই মোসলেহ উদ্দিন। মোশতাক গং অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় চার নেতা হত্যার ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করেছিল।
মোশতাক খুনের জন্য বেছে নেয় কারাগারের মত নিরাপদ জায়গাকে। যে কারাগারে প্রত্যেকটি কয়েদী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা হেফাজতে থাকে এবং প্রত্যেক কয়েদীকে কারাগারে যথাযথ নিরাপত্তা দেয়া রাষ্ট্রের অবশ্য কর্তব্য বলে বিবেচিত হয়। খুনিরা সেই রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে কারাগারে প্রবেশ করে। তারপর সকল আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চার নেতাকে কারাগারের ভিতর ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। খুনিরা শুধু ব্রাশফায়ার করে ক্ষান্ত হয়নি, তারা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে চার নেতার মৃত্যু নিশ্চিত করে বীরদর্পে বেড়িয়ে যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা হেফাজত তথা কারাগারের ভেতর এমন নির্মম হত্যাকান্ডের উদাহরণ বিরল। বাঙালি জাতি চিরকাল এই কলঙ্ক বয়ে যাবে।
লেখক : সাংবাদিক।