কোন পথে জামায়াত আর জাতীয় পার্টি ?

ইয়াহিয়া নয়ন
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ৬:৫০ অপরাহ্ণজাতীয় নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে রাজনীতিতে ঘটছে ততই নাটকীয়তা। অনেক বছরের জোট সম্পর্ক ত্যাগ করে জামায়াতে ইসলামী একলা চলার ঘোষণা দিয়েছে। অপরদিকে এরশাদের জাতীয় পার্টি বিএনপির সাথে জোট বাঁধার খবর সবখানে। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।
১৯ আগস্ট নিখোঁজ বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীর ছেলে আবরার ইলিয়াসের বিয়ের অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের একই টেবিলে বসার পর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে দুই দলের সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে নানা গুঞ্জন শুরে হয়। বিএনপির একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি বিএনপির সঙ্গে কোন উপায়ে ঘনিষ্ঠ হতে পারে সে বিষয় দলের পক্ষ থেকে সূক্ষ্মভাবে ভাবা হচ্ছে।
অপরদিকে বিএনপি জোট ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। গত সপ্তহের এ দুটি ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয় রাজনৈতিক অঙ্গনে। চলছে নানা আলোচনা-পর্যালোচনা। বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন ২০দলীয় জোট থেকে জামায়াতের সরে দাঁড়ানোকে রাজনীতিতে নয়া মেরুকরণের আভাস হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। একইসঙ্গে দেশের চলমান রাজনীতিতে এটি নতুন এক পরিবর্তন বলেও মনে করা হচ্ছে। জামায়াতের জোট ছাড়া নিয়ে অবশ্য মিত্র দলগুলোর মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। এমনকি জামায়াতের নেতাকর্মীরাও এ নিয়ে অখুশি বা উৎফুল্ল নন।
যেহেতু জাতীয় পার্টি ক্ষমতার সুবিধাবাদী একটি রাজনৈতিক দল সেহেতু তাদের নিয়ে সেভাবেই ভাবা হচ্ছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের নেতৃত্ব সংকটের কারণে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে আন্দোলন করে বিএনপি। এবার আন্দোলন সফল হলে প্রয়োজনে বিএনপি জিএম কাদের নেতৃত্বে আগামীতে সরকার গঠন করবে। কৌশলগত কারণে জিএম কাদেরকে প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাবনা দিতে পারে বিএনপি। তবে এর বিপরীত মতামত রয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সুদূরপ্রসারী চিন্তা থেকেই জোট সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামায়াত। এটা হতে পারে তাদের পলিটিক্যাল স্ট্র্যাটেজি। আর এই সিদ্ধান্তের কারণে দুই দলের অবস্থান অনেকটাই পরিষ্কার হয়েছে। কারণ বিএনপি’র পক্ষ থেকে অনেক আগ থেকেই জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার বিষয়ে ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন নেতারা। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে দলের নিবন্ধন ফিরে পেতে চেষ্টা করছে জামায়াত। সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীতে বড় শোডাউন, সিলেট অঞ্চলে বন্যাসহ নানা দুর্যোগে নির্বিঘ্নে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের তৎপরতায় নতুন বার্তা বলে মনে করছিলেন অনেকে।
সিঙ্গাপুর সফর শেষ করে দেশে এসেই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের তার বক্তব্যের ধরন পাল্টে ফেলেছেন। যদিও তিনি অনেকদিন ধরেই বলে আসছেন আমরা আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে নেই। ভবিষ্যতে কোন জোটে যোগ দেবো তা সময় বলে দেবে। গত ২০ মে একটি অনুষ্ঠানে জিএম কাদের বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)। সবগুলো আসনে ইভিএমে ভোট হলে সরকারদলীয় প্রার্থীরা প্রকাশ্যে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। জাতীয় পার্টি প্রহসনের নির্বাচন চায় না। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে জাপার আগের অবস্থান ছিল বিএনপির ঠিক বিপরীতে। তারা শক্তভাবে তত্ত্বাবধায়কের বিপক্ষে কথা বলতেন। দলটির বক্তব্য ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাদের সঙ্গে সঠিক আচরণ করেনি। তাই আমরা তত্ত্বাবধায়কের পক্ষে না। কিন্তু হঠাৎই জিএম কাদের সুর পুরো বদলে ফেলেছেন।
বিভিন্ন সূত্র থেকে আরও জানা যায়, জাতীয় পার্টি থেকে বিএনপির রাজনীতিতে আসা কিংবা বিএনপি থেকে জাতীয় পার্টিতে যাওয়া এমন অনেক নেতাদের পরস্পরের সঙ্গে রাজনৈতিক সংযোগ কিংবা হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। পারস্পরিক নানা আলোচনা থেকে জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক অবস্থানও বোঝার চেষ্টা করছেন বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ। যেখানে আশাবাদী হওয়ার মতো বিষয় রয়েছে বলেও নেতাদের কেউ কেউ জানিয়েছেন। বিগত নির্বাচনগুলোর ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির ভোট একত্র হওয়ার কারণে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় মহাজোট প্রার্থীদের বিজয় শুধু নিশ্চিতই হয়নি, অনেক সহজও হয়েছে। এরশাদের জাতীয় পার্টি এখনো নির্বাচনে অন্যতম ব্যালেন্সিং ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে।
এদিকে বিএনপি’র একটি অংশ অনেক দিন ধরে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে দলের নীতিনির্ধারকদের পরামর্শ দিয়ে আসছেন। তারা বলছেন, জামায়াতের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহলের অনেকের বিরূপ ধারণা রয়েছে। জামায়াত যদি জোট ছেড়ে যায়, বিএনপি তাদের ফেরানোর চেষ্টা করবে না।
এদিকে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপি’র মিত্রতা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে শুরু থেকেই সমালোচনা রয়েছে। বিশেষ করে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াত নেতাদের বিচার এবং ফাঁসির পর সারা দেশে দলটির নেতাকর্মীদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দেশ-বিদেশে আলোচিত-সমালোচিত হয়। তখন থেকে বিভিন্ন মহল থেকে বিএনপি’র ওপর চাপ বাড়ে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার।
সম্প্রতি দলের এক সভায় ভার্চ্যুয়াল বক্তব্যে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০দলীয় জোটের ব্যাপারে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেন জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, আমরা এতদিন একটা জোটের সঙ্গে ছিলাম। ছিলাম বলে আপনারা হয়তো ভাবছেন কিছু হয়ে গেছে নাকি? আমি বলি হয়ে গেছে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত এটি একটি জোট ছিল। ২০০৬ সালের ২৮শে অক্টোবর জোট তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। সেদিন বাংলাদেশ পথ হারিয়ে ছিল। সেটা আর ফিরে আসেনি। ডা. শফিকুর রহমান বলেন, বছরের পর বছর এই ধরনের অকার্যকর জোট চলতে পারে না। এই জোটের সঙ্গে বিভিন্ন দল যারা আছেন, বিশেষ করে প্রধান দলের (বিএনপি) এই জোটকে কার্যকর করার কোনো চিন্তা নাই। বিষয়টা আমাদের কাছে স্পষ্ট দিবালোকের মতো এবং তারা আমাদের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন বাস্তবতা হচ্ছে নিজস্ব অবস্থান থেকে আল্লাহর উপর ভর করে পথ চলা। তবে হ্যাঁ জাতীয় স্বার্থে একই দাবিতে যুগপৎ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবো ইনশাআল্লাহ।
জাতীয় পার্টির নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগ রয়েছে বিএনপির এমন একাধিক সূত্রে জানা যায়, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ে সবদলকে সঙ্গে নিয়ে এগোতে চায় বিএনপি। সেক্ষেত্রে এরশাদের জাতীয় পার্টি ‘ইভিএমে ভোট’ নাকচ করার পাশাপাশি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতেও একটা পর্যায়ে গিয়ে একমত হবে এবং সরকার পতনের কার্যকর আন্দোলন গড়ে উঠবে বলে আশা করছেন তারা। সম্প্রতি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরসহ দলের কয়েকজন নেতা সরকারের সমালোচনায় সরব হয়েছেন। জাতীয় পার্টিকে আপনারা সরকারবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্ব দেওয়ার চিন্তা করছেন কি না? জবাবে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আজম খান মিডিয়াকে বলেন, আমরা আওয়ামী লীগ সরকারকে এবার আর ভোট লুট করতে দেবো না। এ কারণে আওয়ামী লীগ ছাড়া আমাদের আন্দোলনের সঙ্গে সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি। সেই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, ভোটের অধিকার পুনরুদ্ধার, মানবাধিকার পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে এখন যদি জাতীয় পার্টি শরিক হয়, যুগপৎ আন্দোলনে আসে অবশ্যই আমরা স্বাগত জানাবো। রাষ্ট্র মেরামতের আন্দোলনে যারা আমাদের সঙ্গে আসবে সবাইকেই স্বাগত জানাবো।
উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা থেকে শুরু করে করোনা মোকাবিলা, মহামারির বৈশ্বিক স্থবিরতায় অর্থনীতি সচল রাখার মতো ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টে শেখ হাসিনার সরকার বৈশ্বিক মাপকাঠিতেই সফলতা দেখিয়েছে। তবে মহামারি পরবর্তী রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের দরুণ বৈশ্বিক মন্দা, জ্বালানীসহ নিত্যপণ্য মুল্যের উর্ধ্বগতি এখন সরকারের পক্ষে জনমত পক্ষে ধরে রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যেও আশার কথা পদ্মাসেতু চালু হয়ে যাওয়াসহ আগামী এক বছরে আরও কয়েকটি মেগা-প্রকল্পের সমাপ্তি মন্দা পরিস্থিতির মধ্যেও অর্থনীতিতে কিছুটা গতি সঞ্চার করবে সন্দেহ নেই। তবে যুদ্ধ শেষ হবার কোনো লক্ষণ না থাকা, উপরন্তু রাশিয়ার ওপর আমেরিকা-ইউরোপের সেংশনে জ্বালানীর মূল্য যেভাবে বাড়ছে, তাতে বিশেষজ্ঞদের মতে পুরো উন্নয়নশীলসহ বিশ্বের জন্যই সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। এমন এক অবস্থার মাঝেই এগিয়ে আসছে জাতীয় নির্বাচন।
কোনপথে হাটবে আওয়ামীলীগ, সরকার হিসেবে তারা ক্ষমতায় আগামী পর্বে থাকবে কিনা? সেসব নিয়ে আগামীতে লেখা যাবে। বিরোধীরা কতোটা একজোট হয়ে একক কর্মসূচিতে কতোট পথ চলতে পারে তাও পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন। বিস্তারিত আগামীতে লেখার ইচ্ছা রইল।
লেখক : সাংবাদিক,কলাম লেখক।