কোন পথে পাকিস্তান ?

ইয়াহিয়া নয়ন
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ আগস্ট ২০২২, ১২:৩৮ অপরাহ্ণক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছে পাকিস্তান। বেলুচিস্তানে বন্যা আর পাঞ্জাবের রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি বড় খবর হয়ে আসছে অর্থনীতি। পাকিস্তানে জ্বালানির মূল্য এখন আকাশচুম্বী। পেট্রল ও ডিজেল বিক্রি হচ্ছে প্রতি লিটার ২৩০ ও ২৬০ রুপিতে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদ্যুৎ–সংকট। শহর ও গ্রাম সব জায়গায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। ক্ষুব্ধ মানুষ বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন করার দাবি জানাচ্ছে। মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে।
আমরা দেখেছি, জ্বালানির দাম বাড়লে তার প্রভাব পড়ে বাজারে। বিশেষ করে, মূল্যস্ফীতির অন্যতম প্রধান একটি কারণ জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি। আইএমএফ থেকে ঋণ পাওয়ার আশায় জ্বালানির ওপর ভর্তুকি তুলে নিয়েছে পাকিস্তান। এরপর জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে ঠেকেছে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি আর রুপির দরপতনে মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। গত জুনে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি ছিল ২১ দশমিক ৩ শতাংশ। অথচ গত বছরের জুনে মূল্যস্ফীতির এ হার ছিল ৯ দশমিক ৭। পরিবহন ও খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে তা ৬০ ও ৪০ শতাংশ। এতে দেশটিতে যাতায়াত ভাড়ার সঙ্গে অনেক ভোগ্যপণ্যের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এদিকে আমদানি ও রপ্তানি ভারসাম্যহীন। গত জুনে শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট আমদানি ছিল ৮৪ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার। বিপরীতে রপ্তানি ছিল ৩৯ দশমিক ৪২ বিলিয়ন। বাণিজ্য ঘাটতি ৪৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন। আগের অর্থবছরে এ বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৩১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন।
সবদিক সামাল দিতে আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে ঋণ চেয়েও পড়েছে কঠিন সব শর্তের মুখে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রির জন্য অধ্যাদেশে অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। বন্ধুপ্রতিম দেশের কাছেও আর্থিক সাহায্য চাচ্ছে পাকিস্তান সরকার। এর সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তো আছেই। এ কারণে দেশটির অর্থনৈতিক সংকটের অবনতি ঘটেছে। সংকট মোকাবিলা কঠিন করেছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। দেশটিতে ১৯৭২ সালের মে মাসে ১ ডলারের জন্য ৪ দশমিক ৭৬ রুপি গুনতে হতো। এখন খোলাবাজারে ১ ডলার বিক্রি হচ্ছে ২৫০ রুপিতে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত যেমন ক্রমাগত কমছে, তেমনি অর্থনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। পাকিস্তানে এখন বৈদেশিক মুদ্রার মজুত রয়েছে মাত্র ৯ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। অর্থনীতি সচল রাখতে কমপক্ষে তিন মাসের ডলার মজুতের কথা বলা হয়। পাকিস্তানের কাছে বড়জোর এক মাসের ডলারের মজুত আছে।
বিদেশি ঋণের কারণে বিপজ্জনক অবস্থানে থাকা দেশগুলোকে নিয়ে একটি তালিকা করে অর্থনীতিবিষয়ক মার্কিন সংবাদমাধ্যম বøæমবার্গ। সেই তালিকায় পাকিস্তানের অবস্থান এখন চতুর্থ। বর্তমানে পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দেশটির মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৭১ দশমিক ৩ শতাংশ। গত মার্চে পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণ ছিল ১২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ঋণ ও সুদ মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে দেশটিকে ২১ বিলিয়ন ডলার শোধ করতে হবে। ১ জুলাই থেকে এই অর্থবছর শুরু হয়েছে।
পাকিস্তানের যে বিদেশি ঋণ, তার অর্ধেক চীনের। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই প্রকল্পের আওতায় পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডরের অধীন পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রকল্পে ৬৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে চীন। শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটায় নগদ ঋণে অল্প দিনে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর নির্মাণ করেছে চীনা কোম্পানি। তবে ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কা যখন ঋণের অর্থ শোধ করতে পারছিল না তখন চীনের কাছে বন্দরটি ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দিয়ে দেয় কলম্বো।
হাম্বানটোটার মতো পাকিস্তানের গোয়াদরেও ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে চীন। পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেলুচিস্তান প্রদেশের এই গভীর সমুদ্রবন্দর পাকিস্তানে চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডরের মূল কেন্দ্র। কারও কারও আশঙ্কা, চীনের প্রভাব আরও বাড়লে গোয়াদরের পরিণতিও শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটার মতোই হবে।
এখন সংকট কাটাতে পূর্বের মতো এবারও আইএমএফের দ্বারস্থ হয়েছে ইসলামাবাদ। তবে আমার মনে হয়, অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে বারবার আইএমএফের দ্বারস্থ হওয়া পাকিস্তানের জন্য কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। অর্থনৈতিক সংকট যত ঘনীভূত হবে, ততই রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়বে এবং দ্রæত দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও বাড়বে। আমরা বাংলাদেশীরা চাইনা সার্কভুক্ত একটি দেশ দেউলিয়া হয়ে যাক। শ্রীলংকার জন্য আমাদের কস্ট হয়। দেশটিতে এখন যে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা চলছে তার শেষ কোথায় কেউ জানিনা।
আইএমএফের কঠিন সব শর্ত মেনে পাকিস্তানের ঋণ পাওয়াটা সহজ হবে না। সামনে আবার নির্বাচন। ইতিমধ্যে ভর্তুকি কমিয়ে অজনপ্রিয় কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকারের জনপ্রিয়তা কমেছে। ভবিষ্যতে আরও কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ ছাড়া আইএমএফ বা বন্ধু দেশের কাছে ঋণ নিয়ে পাকিস্তানের সংকট কাটবে না। এ জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও নীতি গ্রহণ করতে হবে। এখন পাকিস্তানে যেটা দেখা যাচ্ছে না।
আমার এই লেখার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, শ্রীলংকার পর একই ধরনের সংকটে পড়েছে পাকিস্তান। এদুটি দেশের সংকটের মূলে কি রয়েছে তা আমাদের দেশের অর্থনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক নেতাদের অনুধাবন করে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হবে। মনে রাখতে হবে আমাদেরও ঘরে বাইরে শত্রæ রয়েছে। মিথ্যা বচনের সময় এখন নয়।
এতোদিন শুনে এসেছি গ্যাসে ভাসছে বাংলাদেশ। আজ গ্যাসের অভাবে সার কারখানা বন্ধ, ঘরে জ্বলছে না বাতি। কেন সময় থাকতে অনাবিষ্কৃত খনিগুলোতে অনুসন্ধান করা হয়নি। কুইক রেন্টাল নিয়ে কটু কথা সরকারকে কেন শুনতে হচ্ছে। সময় থাকতে এসব নিয়ে কেন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার এখনই সময়।
লেখক : সাংবাদিক।