রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আশায় গোলাপগঞ্জের ২৩ পরিবার
সিলেটের কন্ঠ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ৩১ ডিসেম্বর ২০২০, ৭:২১ অপরাহ্ণসাজলু লষ্কর:
দেশ স্বাধীন হয়েছে বটে, তবুও আহাজারি কমেনি শহিদ পরিবারে। স্বাধীনতার সুবর্ন জয়ন্তীর সন্ধিক্ষনে দাড়িয়ে প্রিয় বাংলাদেশ। তবুও পুত্র/পিতা/ভাই হারানোর শোকে এখনও কাঁদে প্রতিটি পরিবার। মা তার নাড়ী ছেড়ি ধনের অপেক্ষায় কাঁদতে কাঁদতে চোখ ভিজিয়েছেন। বোন তার আদরের ভাইয়ের অপেক্ষা করতে বৃদ্ধা হয়েছেন। নাড়ি ছেড়া ধনের সন্ধান হয় তো মিলবেনা কোনদিন। তবুও একটু রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আশায় আজও বুক বেধে আছেন বীর শহীদদের স্বজনেরা। বলছি -গোলাপগঞ্জ উপজেলার সুন্দিশাইল গ্রামের সেই ২৩ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কথা।
দেশকে শত্রু মুক্ত করতে হবে-এই তাগিদ থেকেই একাত্তরে টগবগে কয়েক তরুণপ্রাণ হাতে নেয় অস্ত্র। তাদের বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার সুন্দিশাইল গ্রামে। একই গ্রামের উদ্যমী তরুণদের একজন আবদুস সালাম লস্কর। মুক্তিবাহিনীর সদস্য হিসেবে পাক হায়েনারা যেদিন সুন্দিশাইল গ্রামে ঢুকে সেদিন সালামকে খুঁজতে থাকে হন্য হয়ে। মুক্তি বাহিনীতে যুক্ত থাকার অপরাধে সেদিন সালাম লস্করকে গ্রামে খুঁজে না পেলেও পাকিস্তানীরা আবদুস সালামের পিতা খোর্শেদ আলীকে গ্রামের ২৩ জনের সাথে ওপেন ব্রাশ ফায়ারে মৃত্যু নিশ্চিত করে। সময়টি ৭১ সালের ২৪ অক্টোবর।
আবদুস সালামের বয়স তখন ২৪ অথবা ২৫ বছর হবে। পিতা খোর্শেদ আলী কাজ করতেন জাহাজে। ফলে সবাই সারেং সাব নামেই চিনতো। সালাম লস্করের আপন ভাই খলিলুর রহমান লস্কর চাকুরী করতেন। চাকুরী ছেড়ে ভাই সালামের সাথে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। পিতার অনুপ্রেরণা ছিল শুরু থেকেই।
এমনকি মুক্তিবাহিনীর সকলের রান্নার আয়োজন করা হতো এই লস্কর বাড়ি থেকেই। রান্নার কাজ করে দিতেন তাদের বোন শেবু বেগম,সালাম লস্করের মা ও উনার স্ত্রী হালিমা খাতুন। রান্না করা খাবার মুক্তিবাহিনীর হাতে পৌছে দিতেন একই গ্রামের মৃত: মৌলা মিয়া লস্করসহ কয়েকজন। নানা বেশে সেই সব খাবার পৌছে যেতো মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। এক সময় সেই খবরটিও গোপন থাকেনা,পাকিস্তানী বাহিনীর কাছে সেই খবর প্রকাশ হয়ে যায়।
পাশ্বর্তী গ্রামের এক সদস্যকে আচমকা সুন্দিশাইল গ্রামে প্রবেশ করতে দেখে সন্দেহ দেখা দেয় মৃত খলীলুর রহমান মাসটারের । তিনি সেসময় ওই ব্যাক্তিকে গ্রামে ঢোকার কারণ জানতে চাইলেই শুরু হয় বাক বিতন্ডা। এক পর্যায়ে গ্রামের লোকজনের সহায়তায় ওই ব্যক্তিকে গ্রামছাড়া করা হয়। কিন্তু তখন খবর সরাসরি পৌঁছে যায় পাকসেনাদের কাছে। গ্রাম থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর ওই ব্যাক্তি দেওয়া তথ্যমতে পাকিস্তানী বাহিনী সুন্দিশাইল গ্রামে প্রবেশ করে।
তারপর যে ঘটনাটি ঘটলো-তা স্মরণ করা মাত্র এখনো শিউরে উঠেন গ্রামের মানুষ। মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়া ও মুক্তিবাহিনীকে সজযোগীতা করার অপরাধে গ্রামের ২৩ টি পরিবারের সদস্যকে জড়ো করা হয় একসাথে। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই দিন বেঁচে যান আবদুস সালাম লস্কর। কিন্তু আবদুস সালামকে না পেলেও ধরে আনা হয় সালামের পিতা খোর্শেদ আলী কে। অবশেষে পাকিস্তানীরা একসাথে লাইন করে ২৩ পরিবারের ২৩ জনকে ওপের ব্রাশ ফায়ারের মাধ্যমে মেরে ফেলে।
১৯৭৪ সালে আবদুস সালাম লস্কর ব্যক্তিগত উদ্যোগে কবরস্থান খুড়ে হাড়-গোড় উদ্ধার করেন। পরে পোস্ট মর্টেম করানো হয়।আবদুস সালাম লস্করের উদ্যোগে বিয়ানীবাজার থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় সাক্ষি করা হয় বর্তমানে কানাডা প্রবাসি আওয়ামীলীগ নেতা দিলু চৌধুরী। শুধু এখানেই শেষ নয়, গ্রামবাসীর পক্ষে থেকে ২৩ শহীদের সমাধীস্থল সংরক্ষণ করার দাবিতে গ্রামবাসী একাত্ব হলে বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ড.সৈয়দ মকবুল হোসেনের হস্তক্ষেপ গ্রহণ করেন।দায়িত্ব দেন সেসময়ের বাল্য বন্ধু আব্দুস সালাম লস্করেকে। গ্রামবাসীকে নিয়ে সেখানে গড়ে উঠে একটি স্মৃতি সৌধ। জাতীয় দিবসগুলোতে সেখানে পুস্পস্তবক অর্পণ করা হয়।
এদিকে, যুদ্ধ পরবর্তী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৩ পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে একটি চিঠি পাঠান । সেই চিঠিতে প্রতিটি পরিবারের এই আত্মত্যাগকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন তিনি। সেই সাথে পাঠান আর্থিক সম্মানীও। ঢেউটিন, কম্বলসহ সম্মাননা পাঠান সেইসব পরিবারে।
স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরও সেই ২৩ পরিবারের ভাগ্যে জোটেনি রাস্ট্রীয় স্বীকৃতি। বর্তমানে ২৩ শহিদের স্মৃতিসৌধে দিবসগুলোতে পুস্ফস্তবক অর্পন করা হয়। ২০০৭ সালে শহিদ পরিবারের কয়েক উদ্যমী তরুণ মিলে গড়ে তোলেন ‘২৩ শহিদ স্মৃতি সংসদ’ নামের একটি সংগঠন। ২০১০ সালে সেই সংগঠন সরকারি অনুমোদন লাভ করে।
এদিকে , জাতির পিতা থেকে প্রাপ্ত সম্মাননার এতোবছর পরও সেই পরিবারগুলোর ভাগ্যে জোটেনি কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। ২০১৪ সালে শহীদ পরিবার গুলোর পক্ষ থেকে মাননীয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বরাবরে একটি আবেদন পাঠানো হয়। এই আবেদনের ৬ বছর অতিক্রান্ত হলেও এখনও সরকারি স্বীকৃতির আশায় প্রহর গুণছে শহীদ পরিবারের সন্তানেরা।
এ ব্যাপারে‘২৩ শহিদ স্মৃতি সংসদ’ এর সভাপতি এম এ ওয়াদুদ এমরুল বলেন, ‘আমরা গর্বিত যে, দেশমাতৃকার ডাকে সারা দিয়ে আমার গ্রামের লোকজনকে জীবন্ত অবস্থায় সারিবদ্ধভাবে মেরে ফেলা হয়েছে। আমরা সেই সব দেশপ্রেমিকদের গর্বিত উত্তরসূরী।’ কিন্তু দূর্ভাগ্যের সাথে বলতে হয়, এখন পর্যন্ত ২৩ শহীদের সমাধীস্থল অরক্ষিত অবস্থায় আছে। এ ব্যাপারে তিনি জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
শহীদ খোর্শেদ আলীর নাতি এবং মুক্তিযোদ্ধের অন্যতমত সংগঠক আবদুস সালাম লস্করের বড় ছেলে সাবেক ইউপি সদস্য ও আমুড়া ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ নেতা আব্দুস সামাদ লস্কর মিন্টু। বলেন, ‘আমার দাদা খোর্শেদ আলী ছিলেন সেই সময়ে পরিবারের একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ সেই অবলম্বনটুকু কেড়ে নিলেও দমে থাকেনি আমার পরিবার। আমার বাবা আব্দুস সালাম লস্কর দাদাকে হারানোর পর সংসার নামক নতুন যুদ্ধ মোকাবেলা করেন’।
তিনি বলেন, এই ত্যাগ আমার পরিবারের জন্য এবং গ্রামবাসীর জন্য অনেক গর্বের বিষয়। কিন্তু দুঃখ হয়, ২৩ পরিবারের অনেকেই এখনও মানবেতর জীবন- যাপন করছে। তাদের খোঁজ রাখাটাও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব।
তিনি বলেন, আমরা শোক সহ্য করেছি-কিন্তু এখন চাই সেই ত্যাগের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। তিনি জাতীর পিতার সুযোগ্য উত্তরসূরী ও দেশের টানা তৃতীয় মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি ২৩ পরিবারের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানের জন্য জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
একইভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, ২৩ শহীদের পরিবারের মামুনুর রশীদ। তিনি বলেন, দেশ আজ বিজয়ের ৪৯ বছরে পর্দাপন করেছে। এই অবস্থায় ২৩ পরিবারেও বিজয়ের হাসিটুকু গ্রহণের সুযোগ দিতে অবিলম্বে পরিবারগুলোর অবদান স্বরূপ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এখন সময়ের দাবি।
লেখক: সাজলু লষ্কর
সিলেট প্রতিনিধি: এনটিভি ইউরোপ ও
সম্পাদক: সিলেট প্রতিদিন টোয়েন্টফোর ডটকম।
. . . . . . . . .