সজীব ওয়াজেদ জয় ও ডিজিটাল বাংলাদেশ
সিলেটের কন্ঠ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ অক্টোবর ২০২০, ৩:১৮ অপরাহ্ণড. রাশিদ আসকারী
আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি যখন প্রসব বেদনার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল, তখন জন্ম হয় একটি শিশুর। জন্মের বেশ আগেই তার জন্য নাম ঠিক করা ছিল। যে নামের অর্থ ‘বিজয়’। আর সেই বিজয় অর্জিত হয়েছিল তার জন্মের কয়েক মাস পরেই। কে এই শিশু আর কীইবা তার নাম? এটি জানতে আমাদের ঠিকুজি ঘাটতে হবে না, কিংবা খুঁজতে হবে না বিশ্ব ইতিহাসের ভান্ডার। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের প্রিয় এই দেশটির গর্বিত এক সন্তান সে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৌহিত্র ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার একমাত্র পুত্র। নাম জয়। জাতির পিতা নিজেই দিয়েছিলেন এই নাম।
আশ্চর্য কাকতালীয় কিছু বিষয় রয়েছে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম আর জয়ের জন্মের মধ্যে। ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাঁকে গ্রেপ্তার করল এবং বাংলাদেশের মানুষ যখন তীব্র প্রতিরোধ করল, জয় তখন মাতৃগর্ভে। একটি অনাগত শিশুর জন্য তৈরি হচ্ছিল একটি ইতিহাস যে শিশু একজন মহান ব্যক্তি আর তাঁর লেগাসির উত্তরাধিকার। শেখ হাসিনার স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, ২৩ মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু তাঁর ধানমণ্ডির বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনকালে তাঁর সন্তান সম্ভবা কন্যা হাসিনাকে বলেছিলেন ছেলে হলে যেন তার নাম ‘জয়’ রাখা হয়।
১৯৭১ এর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গ্রেপ্তার করে এবং পাকিস্তানে কারাবন্দি করে রাখে। মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে উত্তাল সময়ে যখন বঙ্গবন্ধু পাঞ্জাবের মিয়াঁওয়ালি কারাগারে অবরুদ্ধ, সেই সময় ২৭ জুলাই শেখ হাসিনা একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। তবে বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা পূরণ হয়েছিল। নবজাতকের নাম রাখা হয় ‘জয়’। খুব বেশি ফুটফুটে হওয়ায় তাকে তার মাতামহী শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ‘সজীব’ নামেও ডাকতেন।
মুজিব জেলে। দেশ হানাদার বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত, বিপর্যস্ত। মুজিব পরিবারের এমন দুর্দিনে জয় এসেছিল একটু প্রশান্তির ফল্গুধারা নিয়ে। ‘জয়’ নামটি তার পূর্ণ স্বার্থকতা নিয়ে এসেছিল যখন ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ বাংলাদেশ চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। জয় হয়ে উঠেন মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের প্রতীক। সারা দেশের মুক্তিকামী আপামর জনতার হৃদয়ে মুক্তির দূর্মর আকাঙ্ক্ষা যে ঝাঁঝালো শ্লোগান সৃষ্টি করেছিলো তার নাম ‘জয় বাংলা’। মুক্তির এই মহান সংগ্রাম আর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে সমর্থন জোগাতে একটা প্রজন্মই তৈরি হয়েছিল। তখন অনেকেই তাদের পুত্র সন্তানের নাম রেখেছেন ‘জয়’। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের এক অনন্য অধ্যায় হল এই ‘জয় প্রজন্ম’। সজীব ওয়াজেদ জয় হল তার অনন্য উদাহরণ।
জয় একজন অনন্য প্রতিভাবান পিতা আর এক স্বপ্নদর্শী মায়ের সন্তান। তার পিতা এম এ ওয়াজেদ মিয়া ছিলেন একজন বিখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী, আর মা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং দেশীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিকভাবে একজন বিশ্বমানের রাষ্ট্রনেতা হিসেবে সুবিদিত। আর জয়, ধীশক্তি ও নেতৃত্ব তার রক্তের সাথে মিশ্রিত। প্রাযুক্তিক দক্ষতা আর অনুপম নেতৃত্বের উজ্জ্বল মিশেলে তিনি এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব।
জয়ের বয়স তখন চার, বঙ্গবন্ধু পরিবার ও বাংলাদেশের ভাগ্যে ঘটে যায় এক মর্মচ্ছেদী বিয়োগান্তক ঘটনা। এক কুখ্যাত সামরিক অভ্যূত্থানে তার নানা-নানী সহ পরিবারের সবাই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। বাংলাদেশে থাকলে আগস্টের ভয়াল সেই রাতে তার বাবা, মা এবং খালাও একই নৃশংসতার শিকার হতেন। নিছক দৈববলে তারা বেঁচে গিয়েছিলেন ভ্রমণ ব্যপদেশে জার্মানিতে অবস্থানের কারণে। যাহোক, সমস্ত বিপত্তি আর মানসিক আঘাত সামলে নিয়ে জয় তার পড়াশোনা শেষ করেন সফলতার সাথে। ভারতের ব্যাঙ্গালুরু বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স পড়েছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্পন্ন করেছেন কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এ স্নাতক। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কেনেডি স্কুল অব গভর্নমেন্ট থেকে লোক প্রশাসন বিষয়ে করেছেন স্নাতকোত্তর। পিতামাতার অনুপ্রেরণা, জন্মগত দেশপ্রেম আর বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আদর্শের প্রতি দৃঢ় ও অকৃত্রিম আনুগত্য বর্তমান জয়কে তৈরি করেছে, যাকে আমরা দেখি তার মাতামহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দায়িত্বের উত্তরাধিকারের ভার নিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যেতে।
সজীব ওয়াজেদ জয় প্রযুক্তির বরপুত্র। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, রূপকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশকে বিশ্ব মানচিত্রে প্রতিষ্ঠা করেছেন, শেখ হাসিনা প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন উন্নয়নের সম্রাজ্ঞী হিসেবে, জয় হয়েছেন ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ রূপকল্পের কাণ্ডারী, যা গত দশক থেকেই গুরুত্বের দিক বিবেচনায় সবার উপরে অবস্থান করছে। ২০০৯ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে শুরু হওয়া ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প’ চারটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত – মানব সম্পদ উন্নয়ন, নাগরিক সংযোগ, ডিজিটাল গভর্নেন্স এবং আইসিটি (ICT) ইন্ডাস্ট্রিকে এগিয়ে নেওয়া। মানব সম্পদ বিকাশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষ ও প্রযুক্তিগতভাবে প্রস্তুত (digital-ready) কর্মী গঠনের জন্য রকমারি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রতিবছর প্রায় পাঁচ লক্ষ স্নাতক বের হয় যাদের প্রায় সত্তর হাজার জনকে ইনফরমেশন টেকনোলজিতে দক্ষ পেশাদার হিসেবে প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে। অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইন্সটিটিউটের মতে, অনলাইন শ্রমশক্তিতে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয়। ২০২১ সালের মধ্যে দেশে শতভাগ ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একটা মোটামুটি হিসাব অনুযায়ী, ৯৫ মিলিয়ন ইন্টারনেট আর ১৬৫ মিলিয়ন মোবাইল ব্যবহারকারী নিয়ে বাংলাদেশ এশিয়ায় পঞ্চম এবং বিশ্বে নবম বৃহৎ মোবাইল মার্কেট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেড উচ্চগতির ফাইবার অপটিক সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ‘ইনফরমেশন সুপার হাইওয়ে’র সাথে যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।
আরও আনন্দের বিষয় হল, বাংলাদেশ তৃতীয় সাবমেরিন কেবলের সাথে যুক্ত হওয়ার দোড়গোড়ায় যার মাধ্যমে আমরা ১২ টেরাবাইট ব্যান্ডউইথ (bandwidth) ব্যবহার করতে পারব। আমরা ই-গভর্নেন্সের ক্ষেত্রেও ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছি যার স্বীকৃতি দিয়েছে স্বয়ং ওয়ার্ল্ড সামিট অন দি ইনফরমেশন সোসাইটি (ডব্লিউএসআইএস)। দেশজুড়ে ৫০০০ এরও বেশি ডিজিটাল সেবাকেন্দ্র চালু আছে জনগনকে বিবিধ সেবা প্রদানের লক্ষ্যে। বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরের চতুর্থ স্তম্ভটি হল দ্রুত বর্ধমান আইসিটি শিল্প, যা মানুষকে আর্থিক, টেলিযোগাযোগ এবং স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবা প্রদান করছে। সজীব ওয়াজেদ জয়ের আদর্শিক প্রতিশ্রুতি আর আদম্য তৎপরতায় ডিজিটাল বাংলাদেশের চারটি স্তম্ভই শক্তিশালী হচ্ছে। আর তাই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘আইসিটি ফর ডেভলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড-২০১৬’ অর্জন করেন।
জয় বাংলাদেশে নিয়ে এসেছেন সিলিকন ভ্যালির বীজমন্ত্র− উচ্চ প্রযুক্তি, উদ্ভাবন, উদ্যোগ পুঁজি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। আমাদের আইসিটি শিল্প তাঁর নেতৃত্বে সমৃদ্ধতর হচ্ছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা হিসেবে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ তারই মানস শিশু যার লক্ষ্য হল ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত দেশে রূপান্তরিত করা। এবং গত এক দশকে বাংলাদেশ প্রযুক্তিগত উন্নতিতে একটি বড় অগ্রগতি অর্জন করেছে যার মধ্যে মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা, জনসেবাতে ডিজিটাল প্রবেশাধিকার, মোবাইল ব্যাংকিং এবং তথ্য প্রযুক্তিভিত্তিক রপ্তানি উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে, বাংলাদেশের ১২০ টিরও বেশি কোম্পানি ৩৫ টি দেশে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের আইসিটি পণ্য রপ্তানি করছে এবং ২০২১ সালের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়াবে ৫ বিলিয়ন ডলারে। আইসিটি শিল্পের এই টেকসই অগ্রগতি ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ডিজিটাল অর্থনীতিতে রূপান্তর এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি জ্ঞান অর্থনীতিতে (knowledge economy) রূপান্তরে যথেষ্ট অবদান রাখবে।
জয় একজন বড় স্বপ্নদ্রষ্টা এবং কীভাবে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে হয় তা ভালো করেই জানেন। তিনি একজন দূরদর্শী নেতা এবং প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ। তৃণমূল পর্যায় থেকে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন এবং তারেক জিয়ার মতো রাতারাতি রাজনীতির শ্রেণিসোপান ধরে এক লাফে মগডালে উঠে যান নি।
১/১১র সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শেখ হাসিনার কারামুক্তির আন্দোলন এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে জয়ের ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় স্থান পাবে। তিনি অসাধারণ উদ্ভাবনী চিন্তা ও উদ্যোগী দক্ষতার অধিকারী। তিনি তরুণ সমাজকে তাদের দক্ষতার সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং প্রথাগত ছকের বাইরে গিয়ে সফলতা অর্জনের ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করে চলেছেন। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম তাকে ‘ইয়াং গ্লোবাল লিডারস’দের একজন হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
আমরা যদি আমাদের তরুণ সমাজকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কিংবা ফাইভ জি-এর চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করার মতো উপযুক্ত করতে চাই এবং আমাদের জনসংখ্যার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে চাই, তাহলে জয়ের দেখানো ডিজিটাল বাংলাদেশের রোডম্যাপ ধরে এগুতে হবে এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যত বিনির্মাণে তার সূদুরপ্রসারি পরিকল্পনার ওপরই নির্ভর করতে হবে।
লেখক : ড. রাশিদ আসকারী; সাহিত্যিক-কলামিস্ট, অনুবাদক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এবং উপাচার্য ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
. . . . . . . . .