সন্দেহভাজনরা বিএনপি কর্মী, সবাই ‘নিখোঁজ’

সিলেটের কন্ঠ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ অক্টোবর ২০১৫, ৯:৪১ পূর্বাহ্ণতাভেল্লা হত্যাকাণ্ড
রাজধানীর গুলশানের কূটনীতিকপাড়ায় ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেল্লা হত্যাকাণ্ডে ‘সন্দেহভাজন’ কয়েকজনের হদিস মিলছে না। তাদের পাঁচজনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে গেছে বলে দাবি করছেন স্বজনরা। শুক্রবার পর্যন্ত তাদের ব্যাপারে কোনো খোঁজ পায়নি পরিবার। ‘নিখোঁজ’ এসব ব্যক্তি সবাই রাজধানীর বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা।
তবে তাভেল্লা হত্যা মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলায় এখনো কাউকে গ্রেপ্তার বা আটক করা হয়নি।
মধ্যবাড্ডার ইলেকট্রিক মিস্ত্রি তামজিদ আহম্মদ ওরফে রুবেল (২৯), দক্ষিণ বাড্ডার বিএনপি কর্মী রাসেল চৌধুরী (৩৫), মধ্যবাড্ডার সোহেল ওরফে ভাঙারি সোহেল (৩৫), স্বাধীনতা সরণির শ্যুটার জুয়েল (৩০) এবং মহানগর বিএনপি নেতা এমএ কাইয়ুমের ভাই এমএ মতিনকে (৪৫) আটক করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন তাভেল্লা খুনের ঘটনায় ‘সন্দেহভাজন’ বলে জানিয়েছে গোয়েন্দা সূত্র।
মামলার তদন্তে গঠিত কমিটির প্রধান এবং গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপকমিশনার (ডিসি) মাহবুব আলম বলেন, ‘আমরা সন্দেহভাজন কয়েকজনকে শনাক্ত করেছি। এখনো কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়নি। তবে সন্দেহভাজনরা গোয়েন্দা জালে বা নজরদারিতে আছে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’
এই বিদেশি খুনের পর টুইটার বার্তায় হত্যার দায় শিকার করে মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস- এমন তথ্য দেয় যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক এক ওয়েবসাইট। তবে ঘটনাটি একটি সরকার বিরোধী ‘ষড়যন্ত্র’- এমন তথ্য পেয়েছেন বলে দাবি করছেন তদন্তকারীরা।
২৫ দিন পার হলেও কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করেনি তদন্তকারীরা। সূত্র জানায়, সন্দেহভাজন তিন প্রত্যক্ষ খুনিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছেন তারা। তবে ঘটনার বিশ্লেষণে সন্দেহভাজন হিসেবে অন্তত সাতজনের নাম উঠে এসেছে। তাদের কাউকে ‘আটকের’ কথা স্বীকার করছেন না তদন্তকারীরা।
জানা গেছে, তাভেল্লা খুনের ঘটনায় সন্দেহভাজন যুবক দক্ষিণ বাড্ডার ব-৮৯ বাসার বাসিন্দা শাহজাহান চৌধুরীর ছেলে রাসেল চৌধুরী। তিনি স্থানীয় বিএনপির কর্মী। তার বাসায় গেলে স্বজনরা দাবি করেন, গত ১৫ দিন ধরে রাসেল নিখোঁজ।
রাসেল চৌধুরীর মা আফরোজা আক্তার আভা বলেন, তার স্বামী শাহজাহান চৌধুরী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী। রাসেল আগে বিদ্যুৎ বিভাগে ঠিকাদারী করতেন। বর্তমানে বেকার। আফরোজা আক্তারের দাবি, গত ১০ অক্টোবর সকাল ১১টার দিকে ডিবি পুলিশের পরিচয় দিয়ে একদল লোক এসে রাসেলকে তুলে নিয়ে যায়। এসময় তারা রাসেলের কাছে জানতে চান, ‘তোর পরনের জিন্সের প্যান্ট স্ট্রাইপ গেঞ্জি ও কালো শার্ট কই।’ ওই ব্যক্তিরা রাসেল কী করে জানতে চায়। পরে তারা আলমারি খুলে তল্লাশি চালায়। একপর্যায়ে তারা রাসেলের দুই হাতে হাতকড়া লাগিয়ে দেন।
ডিবির একজন জিজ্ঞেস করেন, ‘তুই কোন দল করিস, ছাত্রদল না যুবদল?’ পরে সাদা কাগজে কিছু একটা লিখলেও তা কাউকে পড়তে দেয়া হয়নি। ওই কাগজে রাসেলের বাবার স্বাক্ষর ও তার মোবাইল নম্বর নেয়।
রাসেলের বাবা শাহজাহান চৌধুরী বলেন, ‘ধরে নেয়ার সময় তারা বলে যায়- ও যদি অপরাধী না হয় তাহলে ছেড়ে দেয়া হবে। অপরাধী হলে কোর্টে দেয়া হবে। এতোদিন হয়ে গেল এখনো কিছুই হয়নি। আমার ছেলে কোথায়, কীভাবে আছে- তা নিয়ে ভয়ে আছি।’
সন্দেহভাজন হিসেবে নাম উঠে এসেছে আরেক বিএনপি কর্মী তামজিদ আহম্মদ ওরফে রুবেলের। তিনি মধ্যবাড্ডার গুদারাঘাট এলাকায় মামা তৌহিদ মিয়ার বাসায় থাকেন। রুবেলের গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের বাগলি এলাকায়। তার বাবার নাম হারিস মোল্লা। এই রুবেলও গত সোমবার থেকে নিখোঁজ। গত বুধবার সন্ধ্যায় তার মামা তৌহিদ মিয়া বাড্ডা থানায় একটি সাধারণ ডায়রি (জিডি) করেছেন।
তিনি বলেন, ‘আমার ভাগিনা কোনো খারাপ কাজে জড়িত তা শুনি নাই। সে মোবাইল ও ইলেক্ট্রিক সামগ্রী মেরামতের কাজ করত। গত সোমবার থেকে ওরে পাই না। অনেক খুঁজছি। পরে দেখি পেপার-পত্রিকায় নাম। তবে পুলিশতো আটকের কথা স্বীকার করে না।’
জানা গেছে, ঢাকা সিটি করপোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এমএ কাইয়ুমের ছোট ভাই এমএ মতিনও গত দু’দিন ধরে নিখোঁজ। স্বজনরা অভিযোগ করছেন, গত মঙ্গলবার রাতে মধ্যবাড্ডার লিংক রোডের বাসার সামনে থেকে মতিনকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়।
মতিনের স্ত্রী দিলরুবা মনি বলেন, মঙ্গলবার রাতে এশার নামাজ শেষে তার স্বামী বাসায় ফিরছিলেন। বাড্ডা লিংক রোডের নিজ বাসার সামনে পৌঁছালে সেখানে আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা সাদা পোশাকের কয়েকজন যুবক তার গতিরোধ করে। এরপর কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নেয়া হয়।
দিলরুবার দাবি, এ ঘটনা দেখে আশপাশের বাসিন্দা ও মতিনের পরিবারের সদস্যরা এগিয়ে এলে ওই যুবকেরা নিজেদের ‘ডিবি পুলিশ’ দাবি করে। এসময় ‘ডিবি পুলিশ’ জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মতিনকে ছেড়ে দেয়া বলে বলে জানায়। পরে মতিনের স্বজনরা বাড্ডা থানায় যান।
তবে এ ধরনের অভিযানের খবর থানা পুলিশের কাছে নেই বলে সেখান থেকে জানানো হয়। তিনি অভিযোগ করেন, এখন পর্যন্ত তার স্বামীর খোঁজ মেলেনি। মতিন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। গার্মেন্ট ব্যবসা করেন। কী কারণে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সে বিষয়টিও তাদের কাছে পরিষ্কার নয়। তবে মতিনের বড় ভাই এমএ কাইয়ুম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
সূত্র জানায়, তাভেল্লা হত্যার ঘটনায় আরেক সন্দেহভাজন দক্ষিণ বাড্ডার স্বাধীনতা সরণির শিমুল তলা বাজার এলাকার সন্ত্রাসী মো. জুয়েল ওরফে শ্যুটার জুয়েল। তিনি ভাড়ায় অস্ত্রবাজি করেন। কয়েক বছর আগে বাড্ডা এলাকার অন্যতম সন্ত্রাসী হিরণকে খুনের মধ্য দিয়ে শ্যুটার জুয়েল আলোচনা আসেন। গত ১০ দিন ধরে জুয়েলও নিখোঁজ বলে দাবি করছেন তার স্বজনরা। জুয়েলের বাবার নাম সোহরাব। তিনি স্থানীয়ের বরাত দিয়ে বলেন, গত ১৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় শিমুল তলা বাজার থেকে ‘ডিবি পুলিশ’ জুয়েলকে ধরে নিয়ে যায় বলে তিনি শুনেছেন। এরপর আর খোঁজ মেলেনি।
আরেক সন্দেভাজন মধ্যবাড্ডার আদর্শনগরের ভাঙারি জিনিসপত্র বিক্রেতা সোহেল ওরফে ভাঙারি সোহেল। গত পাঁচ দিন ধরে তারও হদিস নেই। আদর্শনগরে ভাঙারির ব্যবসায়ী আবুল কালাম বলেন, গত চার দিন ধরে সোহেলকে দেখা যাচ্ছে না।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, তাভেল্লা খুনে সন্দেহভাজনদের মধ্যে অন্যতম মো. রাসেল নামে বাড্ডার আরেক যুবক। তবে রাসেলের বিস্তারিত পরিচয় এবং অবস্থান জানা যায়নি। সন্দেহভাজন হিসেবে নাম এসেছে- লায়েজ উদ্দিন, আলমগীর, ফারুক ও রুবেল (যুবলীগ নেতা চঞ্চলের ভাগিনা) নামে আরও চার জনের। তাদের অবস্থান সম্পর্কেও বিস্তারিত জানা যায়নি। সূত্রমতে, শুক্রবার পর্যন্ত তদন্তকারীরা অন্তত এক ডজন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। প্রত্যক্ষদর্শী ও আলামতের তথ্য যাচাই করতে তারা কথা বলেছেন আরও অনেকের সঙ্গে।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর গুলশানের ৯০ নম্বর সড়কে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক এনজিও ইন্টারচার্চ কো-অর্ডিনেশন কমিশন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন করপোরেশনের (আইসিসিও) প্রফিটেবল অপরচ্যুনিটিজ ফর ফুড সিকিউরিটি (প্রুফ) কর্মসূচির প্রকল্প ব্যবস্থাপক সিজার তাভেল্লাকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুই যুবক তাভেল্লাকে গুলি করে কাছেই অপেক্ষমাণ একজনের মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়।
. . . . . . . . .